মশক নিধনের দায় নিচ্ছে না কেউ
মশক নিধনে সরকারি আন্তঃদপ্তর ‘ঠেলাঠেলি’তে ডেঙ্গু বাড়ছে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, মশক নিধনের দায় স্বাস্থ্য বিভাগের নয়। আবার মশার প্রজননকেন্দ্র হিসাবে খ্যাত ঢাকার পরিত্যক্ত খাল-জলাশয়ের দায় নিতে নারাজ দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু বসে নেই মশা।
বাস্তবতা হচ্ছে, মৌসুম শুরুর আগেই সদর্পে জানান দিচ্ছে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিশ। প্রাণসংহারী এই কীটের আধিপত্য এখন চরমে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে। লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। অকালে ঝরে যাচ্ছে মূল্যবান প্রাণ। সর্বশেষ মঙ্গলবারও নিভে গেল ১৬ জনের জীবনপ্রদীপ। এর মধ্যে আছেন সিনিয়র সহকারী সচিব নাজিয়া সুলতানা, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা ও আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেলের এক শিক্ষার্থী। সিনিয়র সহকারী সচিব নাজিয়ার মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছে না তার পরিবার। তিনি ৮ মাসের সন্তানসম্ভবা ছিলেন। কিছুদিন পরই তার কোল আলো করে পৃথিবীতে আসার কথা ছিল অনাগত সন্তানের। কিন্তু ডেঙ্গুর ছোবলে সব শেষ। ভেঙেচুরে তছনছ তার সাজানো সংসার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মশক নিধনে সরকারি প্রকল্পের সংখ্যা অনেকটা ‘কাজির গরু কেতাবে’ প্রবাদের মতো। এ খাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দের পরিমাণও অনেক। বিপুল অর্থ ব্যয়ে প্রতিবছরই কেনা হচ্ছে কীটনাশক। মশা মারার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। কিন্তু বাস্তবে এসব উদ্যোগের কোনো সুফল মিলছে না। ডেঙ্গুর প্রকোপে পুরো রাজধানীবাসী এখন দৃশ্যত জিম্মি।
অবশ্য এডিসের লার্ভা খুঁজতে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। এমনকি মাঠে নেমে গেছেন খোদ উত্তর সিটির মেয়র। টেলিভিশন ক্যামেরায় তার কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ দেখা যাচ্ছে অহরহ। কিন্তু এতে কাজ হচ্ছে কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ক্ষুব্ধ নাগরিকদের অনেকেই নগর কর্তৃপক্ষের ওপর বিরক্ত। কর্তাব্যক্তিদের মন্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কৌতুকপূর্ণ ট্রল হচ্ছে ব্যাপক।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এডিস নির্মূলে বছরব্যাপী সচেতন থাকলে আজকে এমন করুণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না। বিশ্বের নানা দেশেই এডিসের প্রাদুর্ভাব আছে। প্রতিবেশী ভারত কিংবা মালিয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ডেঙ্গু থাকলেও তা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি নয়। বছরব্যাপী কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে ডেঙ্গু সেখানে অনেকটাই কোণঠাসা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় অপরিকল্পিত জলপ্রবাহ ডেঙ্গু বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া দূষিত পরিবেশ ও নগরবাসীর অসচেনতাও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়িয়ে তুলছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা সিটি কর্তৃপক্ষের দায়সারা এডিস নির্মূল অভিযান।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এডিসের ডিম শুষ্ক পরিবেশে দীর্ঘদিন সুপ্ত থাকে। জলজ আবহাওয়া পেলেই ডিম ফুটে জন্ম নেয় লার্ভা। ফলে এডিস নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। সাধারণ কিউলেক্স মশার চেয়ে এডিস দমনে দরকার বিশেষায়িত উদ্যোগ। ইতোমধ্যে রাজধানীর ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। দেখা গেছে, রাজধানীর ১১টি এলাকা থেকে অধিকসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী আসছেন। কিন্তু এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য হাতের কাছে পেয়েও কাজে লাগানো হচ্ছে না। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকাগুলোতে বিশেষ ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হলে সুফল মিলবে। নিয়ন্ত্রণে আসবে ডেঙ্গুর প্রকোপ।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তিন বছর আগে উচ্চ আদালতে রিট করেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। মঙ্গলবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, এদেশে কেউ দায় নিতে রাজি নয়। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখা যায়। করোনা বিদায় নেওয়ার পর অনেকেই বলেছেন করোনা নিয়ন্ত্রণের কৃতিত্ব তাদের। কিন্তু যদি আমাদের সমাজে দায় নেওয়ার সংস্কৃতি থাকত তাহলে এখনকার ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে অনেকেই শাস্তির মুখোমুখি হতেন।
মশক নিধনের দায় নিচ্ছে না কেউ
তোহুর আহমদ
২৭ জুলাই ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মশক নিধনে সরকারি আন্তঃদপ্তর ‘ঠেলাঠেলি’তে ডেঙ্গু বাড়ছে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, মশক নিধনের দায় স্বাস্থ্য বিভাগের নয়। আবার মশার প্রজননকেন্দ্র হিসাবে খ্যাত ঢাকার পরিত্যক্ত খাল-জলাশয়ের দায় নিতে নারাজ দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু বসে নেই মশা।
বাস্তবতা হচ্ছে, মৌসুম শুরুর আগেই সদর্পে জানান দিচ্ছে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিশ। প্রাণসংহারী এই কীটের আধিপত্য এখন চরমে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে। লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। অকালে ঝরে যাচ্ছে মূল্যবান প্রাণ। সর্বশেষ মঙ্গলবারও নিভে গেল ১৬ জনের জীবনপ্রদীপ। এর মধ্যে আছেন সিনিয়র সহকারী সচিব নাজিয়া সুলতানা, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা ও আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেলের এক শিক্ষার্থী। সিনিয়র সহকারী সচিব নাজিয়ার মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছে না তার পরিবার। তিনি ৮ মাসের সন্তানসম্ভবা ছিলেন। কিছুদিন পরই তার কোল আলো করে পৃথিবীতে আসার কথা ছিল অনাগত সন্তানের। কিন্তু ডেঙ্গুর ছোবলে সব শেষ। ভেঙেচুরে তছনছ তার সাজানো সংসার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মশক নিধনে সরকারি প্রকল্পের সংখ্যা অনেকটা ‘কাজির গরু কেতাবে’ প্রবাদের মতো। এ খাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দের পরিমাণও অনেক। বিপুল অর্থ ব্যয়ে প্রতিবছরই কেনা হচ্ছে কীটনাশক। মশা মারার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। কিন্তু বাস্তবে এসব উদ্যোগের কোনো সুফল মিলছে না। ডেঙ্গুর প্রকোপে পুরো রাজধানীবাসী এখন দৃশ্যত জিম্মি।
অবশ্য এডিসের লার্ভা খুঁজতে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। এমনকি মাঠে নেমে গেছেন খোদ উত্তর সিটির মেয়র। টেলিভিশন ক্যামেরায় তার কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ দেখা যাচ্ছে অহরহ। কিন্তু এতে কাজ হচ্ছে কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ক্ষুব্ধ নাগরিকদের অনেকেই নগর কর্তৃপক্ষের ওপর বিরক্ত। কর্তাব্যক্তিদের মন্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কৌতুকপূর্ণ ট্রল হচ্ছে ব্যাপক।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এডিস নির্মূলে বছরব্যাপী সচেতন থাকলে আজকে এমন করুণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না। বিশ্বের নানা দেশেই এডিসের প্রাদুর্ভাব আছে। প্রতিবেশী ভারত কিংবা মালিয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ডেঙ্গু থাকলেও তা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি নয়। বছরব্যাপী কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে ডেঙ্গু সেখানে অনেকটাই কোণঠাসা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় অপরিকল্পিত জলপ্রবাহ ডেঙ্গু বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া দূষিত পরিবেশ ও নগরবাসীর অসচেনতাও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়িয়ে তুলছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা সিটি কর্তৃপক্ষের দায়সারা এডিস নির্মূল অভিযান।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এডিসের ডিম শুষ্ক পরিবেশে দীর্ঘদিন সুপ্ত থাকে। জলজ আবহাওয়া পেলেই ডিম ফুটে জন্ম নেয় লার্ভা। ফলে এডিস নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। সাধারণ কিউলেক্স মশার চেয়ে এডিস দমনে দরকার বিশেষায়িত উদ্যোগ। ইতোমধ্যে রাজধানীর ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। দেখা গেছে, রাজধানীর ১১টি এলাকা থেকে অধিকসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী আসছেন। কিন্তু এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য হাতের কাছে পেয়েও কাজে লাগানো হচ্ছে না। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকাগুলোতে বিশেষ ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হলে সুফল মিলবে। নিয়ন্ত্রণে আসবে ডেঙ্গুর প্রকোপ।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তিন বছর আগে উচ্চ আদালতে রিট করেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। মঙ্গলবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, এদেশে কেউ দায় নিতে রাজি নয়। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখা যায়। করোনা বিদায় নেওয়ার পর অনেকেই বলেছেন করোনা নিয়ন্ত্রণের কৃতিত্ব তাদের। কিন্তু যদি আমাদের সমাজে দায় নেওয়ার সংস্কৃতি থাকত তাহলে এখনকার ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে অনেকেই শাস্তির মুখোমুখি হতেন।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2024