গত অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি
কাটছাঁটের পরও ব্যয় হয়নি ৩৭ হাজার কোটি টাকা
প্রতি অর্থবছরই অব্যবহৃত থাকে হাজার হাজার কোটি টাকা * দেখতে হবে কৃচ্ছ্রসাধনের ইতিবাচক প্রভাব কিনা -ড. জাহিদ হোসেন
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মাঝামাঝি সময়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কাটছাঁটের পরও বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। অব্যবহৃতই রয়ে গেছে ৩৭ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। এডিপি বাস্তবায়নে অন্যান্য বাধার সঙ্গে নতুনভাবে যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনৈতিক সংকট। তাই সার্বিকভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বাভাবিক গতি ছিল না। এরই প্রভাবে কমেছে সংশোধিত এডিপি (আরএডিপি) বাস্তবায়ন হার। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) অগ্রগতি প্রতিবেদনে উঠে এসছে এসব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, গত অর্থবছরর নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে। আগের সমস্যার সঙ্গে কৃচ্ছ সাধনের বিষয় ছিল। তারও প্রভাব পড়েছে। তবে অর্থ ব্যয় করতে না পারায় জবাবদিহিতা নেই এটা পুরোপুরি সঠিক নয়। খরচ যে হয় না সেটি দৃশ্যমান, কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ে যে জবাবদিহিতা হয় সেটি অদৃশ্যমান থাকে। আমি বলতে পারি, খুব ঘটা করে না হলেও জবাবদিহিতার একটা বিষয় আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরের শুরুতে বড় আকারের উন্নয়ন কার্যক্রম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাস্তবায়ন শুরু হয়। এ সময় এডিপির আকার ধরা হয়েছিল দুই লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছরের ছয় মাস যেতে না যেতেই সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ সময় সংশোধিত এডিপির (আরএডিপি) আকার দাঁড়ায় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এ সময় কাটছাঁট করে বাদ দেওয়া হয়েছিল ১৯ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছর শেষে জুন মাস পর্যন্ত ১২ মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছে এক লাখ ৯৯ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। আরএডিপি বাস্তবায়ন হার দাঁড়িয়েছে ৮৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ অর্থের ব্যয় হয়েছে ৮১ দশমিক ৭৭ শতাংশ, বৈদেশিক সহায়তা অংশের ৯০ দশমিক ৪০ এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ৭৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। অর্থবছর পেরিয়ে গেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক টাকাও খরচ করতে পারেনি।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, গত অর্থবছরের প্রেক্ষাপটটা ছিল ভিন্ন। বৈশ্বিক সংকটের কারণে সরকারই সাশ্রয়ের নীতি নিয়েছিল। এটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এখন যেটা দেখা দরকার সেটা হলো, আরএডিপির বাস্তবায়ন যে ১৬ শতাংশ কম হলো সেটি কতটা সাশ্রয় নীতির কারণে হয়েছে আর কতটা অব্যবস্থাপনা বা অদক্ষতার জন্য হয়েছে। তবে দেখা যায় এডিপি থেকে আরএডিপিতে যে বরাদ্দ কমানো হয়েছিল এর শতভাগই ছিল বৈদেশিক সহায়তার অংশ। কিন্তু সেটিতো কাম্য ছিল না। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে বাস্তবায়ন কম হয়েছে। সেটিও তো কাম্য নয়। এখানে সাশ্রয়ের চেয়ে বরং বেশি ব্যয় করার কথা। যদি কোনো গাফিলতির কারণে আরএডিপির বাস্তবায়ন কমে তাহলে তো সাশ্রয়ী নীতির ইতিবাচক প্রভাব বলা যায় না।
আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল এডিপির আকার ছিল দুই লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। অর্থবছরের মাঝ পথে সংশোধিত এডিপিতে ১৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ছেঁটে ফেলে বরাদ্দ ধরা হয় দুই লাখ ১৯ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। শেষে ব্যয় হয়েছিল দুই লাখ তিন হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৯২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অব্যবহৃত থেকে যায় ১৫ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। সেখান থেকে পাঁচ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা বাদ দিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ ধরা হয় দুই লাখ ৯২৭২ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল এক লাখ ৭১ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা, যা মোট সংশোধিত এডিপির বরাদ্দের ৮২ দশমিক ১১ শতাংশ। অব্যবহৃত থেকে যায় ৩৭ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মূল বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ১৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। পরে ১৩ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা বাদ দিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ দেওয়া হয় দুই লাখ ১১৯৯ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত খরচ হয় এক লাখ ৬১ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অব্যবহৃত থাকে ৩৯ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
সম্প্রতি প্রকাশিত আইএমইডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এডিপি বাস্তায়নে নানা বাধা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করেই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এছাড়া মাঠপর্যায়ে প্রকল্প তৈরি ও বাস্তবায়নে সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা আছে। প্রকল্পের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, নিয়মিত পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) এবং পিএসসি (স্টিয়ারিং কমিটির সভা) সভা না হওয়া। কেনাকাটা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা। একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ পাওয়াসহ নানা বিষয় আছে। এসব বাধার সঙ্গে গত অর্থবছরের নতুন করে যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনৈতিক সংকট। সংকট মোকাবিলায় অগ্রাধিকার অনুসারে বিভিন্ন প্রকল্পকে এ, বি ও সি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। শুধু ‘এ’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর জন্য নির্ধারিত তহবিলের ১০০ শতাংশই ছাড় করা হয়েছিল। ‘বি’র জন্য ৭৫ ভাগ এবং ‘সি’র জন্য অর্থছাড় সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল।
এই উদ্যোগের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আরএডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে।