বিআইডিএস’র স্মরণসভা
অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের ভাবনায় ছিল দেশের অগ্রগতি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রফেসর নুরুল ইসলাম ছিলেন সর্বাঙ্গীণ ও পূর্ণাঙ্গ অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং পরবর্তী সময়ে দেশ পুনর্গঠনে তার ব্যাপক অবদান থাকলেও প্রকৃত মর্যাদা তিনি পাননি। তিনি আন্তর্জাতিক মানের অন্যতম অর্থনীতিবিদ এবং সারা জীবন বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিয়ে গবেষণা করে গেছেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিলেন তিনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও তাকে স্বাধীনতা কিংবা একুশে পদকসহ রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মানজনক পদক দেওয়া হয়নি।
মৃত্যুর পর হলেও এই জ্ঞানতাপস এবং অর্থনীতিবিদদের গুরু নুরুল ইসলামকে পদকে ভূষিত করা উচিত। ‘অধ্যাপক নুরুল ইসলাম : নানা প্রজন্মের দৃষ্টিতে দেখা’ শীর্ষক স্মরণসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। রোববার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এ সভার আয়োজন করে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সংস্থাটির সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, প্রবীণ আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন এবং সংসদ-সদস্য রাশেদ খান মেনন।
বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে সভায় আলোচক ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন, বিআইডিএস-এর সাবেক মহাপরিচালক ড. কাজী শাহাবউদ্দিন, ইকোনমিক রিসার্স গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির, পিআরআই-এর পরিচালক ড. আহমেদ আহসান এবং প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।
বক্তব্য দেন প্রফেসর নূরুল ইসলামের কন্যা ড. রুমেন ইসলামসহ আরও অনেকে।
এমএ মান্নান বলেন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম অত্যন্ত নরম মনের মানুষ ছিলেন। সেই সঙ্গে মানবিক মানুষও। আমরা মনে করি, নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহানরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার অথর। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩-৭৪ সালে পরিকল্পনা কমিশন নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে যে মর্যাদায় উঠেছিল, তারা যে উচ্চ পতাকা নিয়ে চলতেন, পরবর্তী সময়ে তা নিচে নেমেছে। ওই মর্যাদা আর এখন নেই। পরিকল্পনা কমিশনের একটা ঐতিহ্যবাহী অতীত তারা রেখে গেছেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে-বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে ’৭৪ সালে পরিকল্পনা কমিশনে যারা ছিলেন, তারা কেন একে একে চলে গেলেন। তবে যাই হোক, প্রথিতযশা মানুষদের মনে তিনি ছিলেন অন্যতম।
ড. মসিউর রহমান বলেন, অর্থনৈতিক ক্যাডারদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাদেরকে প্রশাসক ক্যাডারে যুক্ত করেছে। তবে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাডার সংস্কার দরকার। প্রফেসর নুরুল ইসলাম সম্পর্কে বলেন, আমরা সবাই একটা সময় প্রাসঙ্গিক থাকলেও একটা সময় আর প্রাসঙ্গিক থাকি না। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকলে প্রাসঙ্গিকতা কমে যায়। নুরুল ইসলামের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। তবে এটা ঠিক যে, গবেষণার প্রয়োগের দিকটি বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তার মূল অংশে ছিল দেশ। ওই সময় যেসব সমস্যা ছিল, তিনি গবেষণা প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করেছেন। তখন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মপরিধি ব্যাপক ছিল। তবে তখন প্রশাসন ও পরিকল্পনা কমিশনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল।
ড. কামাল হোসেন বলেন, দুই পাকিস্তানের বৈষম্য নিয়ে নুরুল ইসলাম ব্যাপক কাজ করেছেন। তাকে দেশে এনে বঙ্গবন্ধু যে কাজে লাগিয়েছিলেন, সেখানে আমার ভূমিকা ছিল। ১৯৬৯ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার তৈরিতে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল। এছাড়া ১৯৭১ সালের মার্চে যুদ্ধকালীন দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা আমরা নুরুল ইসলামের বাসায় বসে করেছিলাম। তিনি বঙ্গবন্ধুকে অনেক বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।
রাশেদ খান মেনন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষাজীবন পরিসমাপ্তি এবং পূর্ণাঙ্গ করতে নুরুল ইসলাম স্যারের ব্যাপক অবদান আছে। আমি জেলখানায় বসে একবার পরীক্ষা দিতে পেরেছিলাম। সেখানে স্যারের ভূমিকা ছিল। তার স্নেহ আমি পেয়েছি। তবে তিনি কখনো কাউকে উপযাচক হয়ে পরামর্শ দিতেন না। সারা জীবন তিনি বাংলাদেশকে ভালোবেসে গেছেন। বিদেশে থাকলেও তার বেশির ভাগ কাজই ছিল বাংলাদেশকে ঘিরে। আমি তার ছাত্র হিসাবে গর্বিত।
প্রফেসর ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, প্রফেসর নূরুল ইসলাম ছিলেন একজন সর্বাঙ্গীণ ও পূর্ণাঙ্গ অর্থনীতিবিদ। উন্নয়ন অর্থনীতিতে তার ব্যাপক গবেষণা রয়েছে। এক্ষেত্রে তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া যায়। তিনি শুধু তাত্ত্বিক অর্থনীতিতে নয়, বাস্তব অর্থনৈতিক গবেষণা প্রয়োগযোগ্য করা যায় কীভাবে, সেটি দেখিয়েছিলেন। তার গবেষণা নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে আবদ্ধ ছিল না। তিনি উন্নয়ন অর্থনীতি থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন, এমনকি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়েও কাজ করেছেন। এরকম তীক্ষ্ণ মেধাবী অর্থনীতিবিদ আমি আর কাউকে দেখিনি। পৃথিবীর অনেক নোবেল বিজয়ী তার সঙ্গে যুক্তিতে পারতেন না।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ছয় দফা এবং ওই সময়ে নির্বাচনি ইশতেহার তৈরিতে বঙ্গবন্ধু তাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি বাস্তবভিত্তিক অর্থনীতির চর্চা করতেন। যার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা মিলে গিয়েছিল। তাই তো বঙ্গবন্ধু তাকে এত পছন্দ করতেন। অর্থনীতির সব শাখায় তার বিচরণ ছিল। পাশাপাশি ছিলেন রাজনীতিসচেতন মানুষ।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, একবার নুরুল ইসলামকে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের সমস্যা কীভাবে সমাধান হবে? তিনি বলেছিলেন, একটা শক্তিশালী, শিক্ষিত ও শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠতে হবে। আর এটি গড়ে উঠবে ঘাম ফেলা, ঘাম ফেলা আর ঘামের মাধ্যমে। এ ঘাম শ্রমের ঘাম নয়, জ্ঞানচর্চার ঘাম হতে হবে। তার ৯০ বছর ছুঁইছুঁই সময় থেকে পরবর্তী সময় পর্যন্ত চারটি বই প্রথমা প্রকাশনী থেকে আমরা প্রকাশ করেছি। এত বয়সেও তিনি দেশের জন্য আগামী প্রজন্মের জন্য কাজ করেছেন।
ড. বিনায়ক সেন বলেন, বিদেশে না গেলে কেউ অত বেশি প্রতিষ্ঠা পান না। দু-একজন ব্যতিক্রম থাকতে পারেন। ভারতীয়রা কখনো প্রশ্ন তোলেন না তাদের দেশে জ্ঞানীগুণীরা কেন বিদেশে থাকছেন। কিন্তু আমরা প্রশ্ন তুলি। তার যে যোগ্যতা এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে অবদান তিনি রেখে গেছেন, অবশ্যই তাকে স্বাধীনতা বা একুশে পদক দেওয়া উচিত। পরিকল্পনা কমিশনে তিনি সবচেয়ে ব্যালেন্সড মানুষ ছিলেন।