Logo
Logo
×

শেষ পাতা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাটের সিন্ডিকেট

স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় দুর্নীতিবাজের থাবা

Icon

মুসতাক আহমদ

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় দুর্নীতিবাজের থাবা

ফাইল ছবি

রাজধানীর মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে এক বছরের বেশি সময় অস্থিরতা চলছে। এর মূল কারণ অধ্যক্ষের পদ দখল। এ পদটি দখলে থাকলে ৩৮ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আয় এবং নানান কাজের ব্যয়ের টাকার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়। তাই একজন জুনিয়র শিক্ষককে ওই পদে বসিয়েছিলেন স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। এরপর প্রায় ১৫ বছর চলে দখলদারিত্ব।

সম্প্রতি গণেশ উলটে যায় সংশ্লিষ্টদের অতি লোভের কারণে। শতভাগ কবজায় নিতে ‘এমপিওভুক্ত’ প্রতিষ্ঠানটিকে ‘ট্রাস্টের’ অধীনে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এতে ফুঁসে ওঠেন দীর্ঘদিন নিপীড়িত শিক্ষক-কর্মচারীরা। তারা আন্দোলনে নামেন। অভিযোগ তদন্ত করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। উচ্চ আদালতে একাধিক মামলা হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিন্ডিকেটের বাইরের একজন সিনিয়র শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। কিন্তু পরিচালনা কমিটি সম্প্রতি আরেকজনকে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করে। এ নিয়ে ফের অস্থিরতা শুরু হয়। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে তদন্ত চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটিতে সাবেক অধ্যক্ষ এবং অফিস সহকারী হুমায়ুন রশিদসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ২০০ কোটি টাকা লুটের অভিযোগ পড়েছে। পাশাপাশি আছে অন্যান্য দুর্নীতি ও সরকারের রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু মনিপুরই নয়, রাজধানীসহ দেশের প্রায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই একইভাবে চলছে লুটপাট। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষক-কর্মচারীদের দুর্নীতিবাজ অংশ মিলে তৈরি করে সিন্ডিকেট। দুর্নীতি নির্বিঘ্ন করতে এই অপরাধীরা প্রথমেই প্রতিবাদী শিক্ষক-কর্মচারীদের নিপীড়ন শুরু করে।

কাউকে বরখাস্ত, কাউকে শোকজ বা বেতন বন্ধ করে দেয়। এছাড়া বেয়াদব শিক্ষক-কর্মচারীদের লেলিয়ে দেওয়াও হয়। এভাবে নানাভাবে চাপে রেখে দুর্নীতিবাজরা লুটপাটের মহোৎসবে মেতে ওঠে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগ তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষায়িত সংস্থা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। এ সংস্থার পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট বন্ধ না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে বিচারহীনতা। অপরাধের জন্য পরিচালনা কমিটিকে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে।

লুটে নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ারও নজির নেই। আর পর্ষদ পক্ষে থাকলে অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষককেও ন্যূনতম বেকায়দায়ও পড়তে হয় না। এমনকি তারা না চাইলে ডিআইএ’র তদন্তের ভিত্তিতে কোনো বিচারও হয় না। এক্ষেত্রে অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে কমিটি ভেঙে দেওয়া। মূলত এসবেরই সুযোগ নিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা না গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাঁচানো কঠিন হবে।

দেশে বর্তমানে মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৩৮ হাজার। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩০ হাজার। এছাড়া ১ হাজারের মতো সরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা আছে। গত কয়েক বছরে ডিআইএ কেবল রাজধানীর যেসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি খুঁজে বের করেছে, সেগুলোর মধ্যে আছে-মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, ধানমন্ডি আইডিয়াল, রামপুরার একরামুন্নেসা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ভিকারুননিসা নূন, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল, মিরপুরের শাহ আলী স্কুল ও

শাহ আলী কলেজ, মিরপুর কলেজ, উইলস লিটল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, রাজধানীর হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ, আরকে চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন প্রক্রিয়াধীন আছে মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উদয়ন উচ্চবিদ্যালয়সহ রাজধানীর আরও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তদন্তে এসব প্রতিষ্ঠানে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, নিয়োগ ও ভর্তি-বাণিজ্য, টিউশন ও অন্যান্য ফি, খাতা-কলম-কাগজ এবং স্কুল ড্রেস-ডায়েরি ইত্যাদি বিক্রি থেকে লব্ধ আয়ের একটি অংশ হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য বের হয়েছে। আরও আছে অবৈধ ও নিম্নমানের গ্রন্থ পাঠ্যভুক্তি, এর বিনিময়ে প্রকাশকদের কাছ থেকে কমিশন আদায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির মধ্যে আরও আছে-শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা চালুর পর জাল সনদে চাকরি প্রদান ও এমপিওভুক্তি। হালে এই তালিকায় আরও যুক্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি-গাড়ি ক্রয়, ভবন নির্মাণ, বিভিন্ন ধরনের সংস্কার ও উন্নয়ন কাজের নামে অর্থ লুটের প্রবণতা। প্রতিষ্ঠানের জমি বিক্রি ও স্থাপনা দখল করে নেওয়ার ঘটনা উদ্ঘাটিত হচ্ছে। অবিশ্বাস্য হারে ‘সিটিং অ্যালাউন্স’ গ্রহণও আরেকটি বড় খাত।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত অর্থ এ ব্যাংক থেকে ও ব্যাংকে এফডিআর করে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ আসছে প্রায়ই। অসাধু শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের জিম্মি করে কোচিং-প্রাইভেটে বাধ্য করে আসছেন বহুদিন ধরে। এই কোচিংবাজদের ‘সুরক্ষা’র বিনিময়ে কমিটি ও অসাধু নেতা-শিক্ষকরা বখরা নেন। প্রতিষ্ঠানের টাকা ব্যক্তির নামে খোলা হিসাবে গ্রহণ করে অবাধে নেওয়ার মতো অভিযোগও আসছে।

সম্প্রতি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির কার্যক্রম নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রতিবেদনের একটি অংশে স্কুল-কলেজে অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুস বাণিজ্যের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই টাকা দিতে হয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পরিচালনা কমিটিকে।

আবার কেবল আর্থিক দুর্নীতি নয়, কমিটিতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমি গিলে খাওয়ার রেকর্ড আছে। কেবল ডিআইএ’র তদন্তেই ৮৯৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩১৬ দশমিক ৬৯৮৬৮ একর জমি বেহাত হওয়ার তথ্য আছে। সম্প্রতি মিরপুরের শাহ আলী স্কুলের তদন্তে সংস্থাটি দেখেছে, স্কুলের জমিতে মার্কেট হলেও এর মালিকানা নেই প্রতিষ্ঠানটির।

ডিআইএ প্রতিমাসে গড়ে ২ হাজার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও তদন্ত করে থাকে। এই হারে তদন্তকাজ চলতে থাকলে একটি প্রতিষ্ঠানে ফিরতি তদন্তে যেতে এই সংস্থার কমপক্ষে ২০ বছর লেগে যাবে। এই পরিস্থিতিতে সংস্থাটি নিয়মিত তদন্তের পরিবর্তে অভিযোগ পেলে কাজে নামার নীতিতে চলছে। কিন্তু এ অবস্থায়ও যে সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও বেআইনি কাজ চিহ্নিত হয়, এর জন্য শাস্তি পাওয়ার নজির খুব কমই।

এ সংক্রান্ত ফাইল নিষ্পত্তি হয় খুবই ধীরগতিতে। তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও দুর্নীতিবাজদের রেহাই পাওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। আবার কখনো যদি মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেয়, পরিচালনা কমিটি বাস্তবায়ন না করলে অপরাধীর সাজা হয় না। সবমিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টাকা একবার পেটে চলে গেলে তা প্রতিষ্ঠানের তহবিলে ফিরে আসার নজির খুব একটা নেই। যদিও ২৪ মে জাল সনদে নিয়োগ পাওয়া ৬৭৮ শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চিঠি গেছে। কিন্তু বাস্তবে ডিআইএ ১৫৭৭ শিক্ষককে চিহ্নিত করেছে।

ডিআইএ-এর যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির সবচেয়ে বড় সুযোগ তৈরি করে রেখেছে প্রবিধানমালা। সভাপতির স্বাক্ষর ছাড়া কিছু হয় না।

অথচ তাকেই জবাবদিহি এবং শাস্তির বাইরে রাখা হয়েছে। আবার সভাপতির হাতে চাকরি থাকায় অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষক চাইলেও প্রতিবাদ করতে পারেন না। কিন্তু অনিয়মের শাস্তি আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা হিসাবে তাকেই ভোগ করতে হয়। তাই এই প্রবিধানমালায় সভাপতিকে দায়বদ্ধ করতে হবে এবং শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাহলে প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি তো কমবেই, অনেকে সভাপতিও হতে চাইবে না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম