ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব
সরঞ্জাম সংকটে চরম বিপাকে হৃদরোগীরা
যন্ত্রপাতির দাম ২৫ শতাংশ বাড়ল
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডলার সংকটে অন্যসব পণ্যের মতো হৃদরোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত আমদানিনির্ভর সরঞ্জামের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে জরুরি অস্ত্রোপচারের জন্য হার্টের রিং, অ্যাওটিক ভাল্ব, পেসমেকার, বেলুন ও অক্সিজেনেটর সরবরাহে টান পড়েছে।
ডলারের বাড়তি দামের অজুহাতে ব্যবসায়ীরাও মূল্য বাড়িয়েছেন। চাহিদা অনুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না পাওয়া এবং উচ্চমূল্যের কারণে হৃদরোগীদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যুগান্তরকে জানায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পাঁচ মাস ধরে এলসি (ঋণপত্র খোলা) জটিলতায় পড়তে হয়েছে। এতে হৃদরোগসহ অন্যসব চিকিৎসায় ব্যবহৃত আমদানিনির্ভর সার্জিক্যাল ডিভাইস সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়ছে।
হার্টের সার্জিক্যাল পণ্যের দাম বাড়ানো এবং এলসি খোলার সহায়তা পেতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আবেদন করা হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২১ ডিসেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। ৪ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয় এলসি খোলার ব্যবস্থা করে।
দাম বৃদ্ধির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ১ মার্চ থেকে চিকিৎসা যন্ত্রপাতির দাম শতকরা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমোদন দিয়েছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল ডিভাইস ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার্স অ্যান্ড ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি খোলার অনুমতি দিয়েছে। সরঞ্জাম দেশে আসতে আরও তিন মাস সময় লাগবে।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলেন, দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার প্রায় ২৭ শতাংশ। প্রতি হাজারে ১০ জন শিশু হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন হৃদরোগের ঝুঁকিতে।
এরপরও জীবনরক্ষাকারী রিং ও পেসমেকারসহ চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে গরিব ও মধ্যবিত্ত রোগীরা বিপাকে পড়েছেন। রাজধানী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, ইব্রাহিম কার্ডিয়াকসহ একাধিক হাসপাতাল ঘুরে হৃদরোগীদের দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে।
জানুয়ারির মাঝামাঝি অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে আসেন পাবনার সোহাগ হোসেন। চিকিৎসকরা জানান, রোগীর হার্টে দ্রুত রিং পরাতে হবে। এনজিওগ্রামসহ এক লাখ টাকার মতো খরচ পড়বে। পেশায় রাজমিস্ত্রি সোহাগ প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে না পেরে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি চলে যান। বৃহস্পতিবার তিনি মোবাইল ফোনে জানান, টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। তবে ১ লাখ ৮ হাজার টাকার রিং এখন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা হয়েছে বলে তিনি শুনছেন। টাকা জোগাড় না হওয়ায় ঢাকায় আসতে পারছি না। এদিকে স্ত্রীর অবস্থার অবনতি হচ্ছে।
হৃদরোগ চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দাবি বিশ্বমন্দার কারণে প্রতিটি সরঞ্জামের আমদানি খরচ ১৫ থেকে ২৫ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। যে রিংয়ের দাম ছিল ৭২ হাজার টাকা, সেটি এখন ৮২ হাজার টাকা হয়েছে। একইভাবে ১ লাখ ৮ হাজার টাকার রিং এখন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং দেড় লাখ টাকার রিং ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা হয়েছে। ৯৫ হাজার টাকার পেসমেকারের দাম ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা হয়েছে। ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের এক চিকিৎসক যুগান্তরকে বলেন, রোগ নির্ণয়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি করতে না পারায় কয়েক মাস আগে থেকে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। চিকিৎসাসেবাও ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ইতোমধ্যে কার্ডিয়াক সার্জারির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে হৃদরোগীদের মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে।
একটি সূত্র জানায়, শুধু যন্ত্রপাতি আমদানি নয়, এলসি খোলার প্রতিবন্ধকতায় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও বিপাকে পড়েছে। ওষুধের কাঁচামালগুলোর বেশির ভাগ চীন, ভারত ও জার্মানিসহ ইউরোপের দেশ থেকে আসে। সময়মতো মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় কাঁচামাল পেতে সমস্যা হচ্ছে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, দেশে হৃদরোগ চিকিৎসায় একমাত্র বিশেষায়িত ও বেশি ভরসার স্থল এ হাসপাতাল। এখানে প্রতিদিন হার্টের ছোট-বড় অস্ত্রোপচার হয়। রোগীদের ৭০ শতাংশ গরিব। কিন্তু হৃদরোগ চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম বাড়ানোয় রোগীদের কষ্ট হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আগে হার্টের চিকিৎসার সরঞ্জামের দাম বাড়ানো নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে ঔষধ প্রশাসন আলোচনা করত। কিন্তু এবার তাদের কিছুই জানানো হয়নি। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আইয়ুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। সেটি বিশ্লেষণ করে দাম বাড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ডলার ও কাঁচামালের দাম কমলে আবারও সমন্বয় করা হবে।