বাস্তবায়ন হয়নি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা
অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পুরান ঢাকা
চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের ৪ বছর: এখনো অলিগলিতে রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা, ৭০ শতাংশ সড়ক অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী
মাহমুদুল হাসান নয়ন ও কাওসার মাহমুদ, পুরান ঢাকা
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও সরু গলির পুরান ঢাকা বড় ধরনের অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১০ সালে নিমতলী ট্র্যাজেডি এবং ২০১৯ সালের চুড়িহাট্টার আগুন থেকেও শিক্ষা না নেওয়ায় এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই এলাকার মোড়ে মোড়ে এখনো রাসায়নিক গুদাম ও প্লাস্টিক কারখানা রয়েছে। এর বেশির ভাগই অবৈধ। এসব স্থানে সামান্য আগুনও বাসিন্দাদের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। কারণ, এই অঞ্চলের ৭০ শতাংশ সড়ক এখনো অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী। ফলে ছোট আগুনের ঘটনাও নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ব্যর্থতায় বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এদিকে সংকট নিরসনে সুপরিকল্পিত উদ্যোগ এবং তা বাস্তবায়নের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখছেন না সংশ্লিষ্টরা। বরং ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন ও রাজউক দায়সারা বক্তব্য দিয়েই বছরের পর বছর পার করছে। উপেক্ষা করা হয়েছে অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনাও।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। মর্মান্তিক এ অগ্নিদুর্ঘটনার চার বছর অতিবাহিত হয়েছে। এ অবস্থায় নিহতদের স্বজনরা নিরাপদ পুরান ঢাকার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাত দফা দাবি জানিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। সোমবার সরেজমিন দেখা যায়, সকাল থেকে চুড়িহাট্টার ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে কালো ব্যাজ ধারণ করে জড়ো হন অগ্নিকাণ্ডে নিহতের স্বজনরা। তবে এ দুর্ঘটনার পর নানা সংস্থার অভিযানে বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ফের খুলেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। চুড়িহাট্টার ঘটনার পর এই ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। এজন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে অস্থায়ী গুদাম তৈরির কথা বলা হয়। অথচ গুদাম তৈরির সেই উদ্যোগ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। শেষ হয়নি চুড়িহাট্টার মামলার বিচার প্রক্রিয়াও। উলটো এ মামলার আসামিরা জামিনে বেরিয়ে হুমকিধমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ নিহতদের স্বজনদের।
অগ্নিকাণ্ডে নিহত ওয়াসি উদ্দিন মাহির চাচাতো ভাই এবং চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আশিক উদ্দিন সৈনিক। তিনি যুগান্তরকে জানান, যেই ওয়াহিদ ম্যানশন থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, ওই ভবনেই এখনো প্লাস্টিকের গোডাউন রয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ঘটনার দ্রুত বিচার দাবি করছি।
অগ্নিকাণ্ডে নিহত মো. ফায়সাল সরওয়ারের স্ত্রী ফাতেমা বেগম যুগান্তরকে বলেন, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দুই সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছি। স্বামী হত্যার বিচার চাই। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে-পুরান ঢাকা থেকে সব ধরনের ক্ষতিকারক দাহ্য, রাসায়নিক পদার্থ ও কেমিক্যালের গোডাউন- কারখানা নিরাপদ স্থানে সরানো; মোবাইল কোর্ট গঠন করে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে গোডাউন ও কারখানা উচ্ছেদসহ বাড়ির মালিককে জরিমানার আওতায় আনা; লাইসেন্সবিহীন অবৈধ নকল প্রসাধনী তৈরির কারখানা ও সব ধরনের ক্ষতিকারক দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ, কেমিক্যালের গোডাউন ও কারখানা অবিলম্বে সিলগালা করা। তাদের আরও দাবি-পুরান ঢাকায় আবাসিক ঘনবসতি এলাকার চৌরাস্তার মোড়গুলোয় একটি করে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করতে হবে। এছাড়া চুড়িহাট্টার মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমরা ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা শনাক্ত করেছি। গোডাউন উচ্ছেদে সিটি করপোরেশনকে সুপারিশ করেছি। এ সুপারিশ কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, তা সিটি করপোরেশন ভালো বলতে পারবে।
এদিকে চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কর্তৃক ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এসব কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেওয়া এবং অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। জানা যায়, কমিটিগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীরা। নানা যুক্তি দেখিয়ে তারা সেখান থেকে কারখানা সরাতে চাচ্ছেন না। আর তাদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পকেট ভারী করার অভিযোগ রয়েছে তদারকসংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, পুরান ঢাকার গুদাম সরাতে আমরা কাজ করছি। এছাড়া সড়ক প্রশস্ত করে কীভাবে অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত গাড়িগুলো চলাচলের ব্যবস্থা করা যায়, সেই চিন্তাও আমাদের রয়েছে। তবে যেখানে প্রশস্ত সড়ক নেই, সেখানে নতুন করে বহুতল ভবন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে হবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে।
এদিকে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল-পরিকল্পিতভাবে কেমিক্যাল শিল্প জোন গড়ে তোলা। সেখানে পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া। এর পাশাপাশি দাহ্য কেমিক্যাল আনা-নেওয়া বন্ধসহ সেখানে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা। কিন্তু এত বছরেও প্রধানমন্ত্রীর সেসব নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি।
জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন যুগান্তরকে বলেন, পুরান ঢাকার ৭০ শতাংশ রাস্তাই ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি তো নয়ই, ছোট গাড়ি চলাচলেরও উপযুক্ত না। বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। এ কারণেই হাজারীবাগ এলাকায় ‘আরবান রিজেনারেশন প্রজেক্ট’ বাস্তবায়নে কাজ চলছে। যেখানে ৮-১০টি প্লট মিলিয়ে একটি অ্যাপার্টমেন্ট হবে। প্রশস্ত সড়ক হবে। সবাইকে প্রাপ্য অনুযায়ী ভাগ দেওয়া হবে। এছাড়া যারা অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ করছে, তাদের বিরুদ্ধেও আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
২০১০ সালে নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদামে আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যুর পর থেকে বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করতে থাকেন। যে কোনো সময় ফের বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছিলেন তারা। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে ৭১ জনের মৃত্যুর মাধ্যমে সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, কেবল দুর্ঘটনা ঘটলে তৎপরতা না দেখিয়ে বছরব্যাপী তদারকি প্রয়োজন। অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন সময়ে আসা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশগুলোরও বাস্তবায়ন জরুরি। তাহলেই এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।