Logo
Logo
×

শেষ পাতা

২১ বছরেও হয়নি স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল

হাতের ইশারায় ২০ লাখ গাড়ির নিয়ন্ত্রণ

রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থা: প্রক্রিয়ার গলদে পানিতে দেড়শ কোটি টাকা * প্রশিক্ষিত লোকবল না থাকলে সফলতা আসবে না -অধ্যাপক সামছুল হক

Icon

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাতের ইশারায় ২০ লাখ গাড়ির নিয়ন্ত্রণ

ঢাকায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু করতে ২১ বছর আগে পদক্ষেপ নিলেও তা অদ্যাবধি পূর্ণাঙ্গরূপে কার্যকর হয়নি।

ফলে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় নিয়ন্ত্রণ হয় প্রায় ২০ লাখ যানবাহন চলাচল। প্রক্রিয়ার গলদ আর সমন্বয়হীনতায় জলে গেছে দফায় দফায় খরচ করা প্রায় দেড়শ কোটি টাকা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকায় ব্যাপক হারে সিগন্যাল বাতি স্থাপন শুরু হয় চলতি শতাব্দীর শুরুর দিকে। ২০০২ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকার অন্তত ৭০টি ইন্টারসেকশনে সিগন্যাল বাতি বসানো হয়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এক বছরও টেকেনি এসব বাতি। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে আরেক দফায় বসানো হয় সিগন্যাল বাতি। সিগন্যাল বাতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেনা হয় রিমোর্ট কন্ট্রোল সিস্টেম। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষ আর ট্রাফিক বিভাগের সমন্বয়ের অভাবে ১১০টি স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালের একটি ছাড়া প্রায় সবই অকার্যকর থাকে। দিনরাত সিগন্যাল বাতি জ্বললেও তা কাজে আসছে না। একরকম ‘শোপিস’ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব বাতি। লাল বাতি জ্বললে যানবাহন চলছে, দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সবুজ বাতিতে। বেশির ভাগ মোড়েই এখন এই অবস্থা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে সিগন্যালিং ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে না। তা ছাড়া নগর কর্তৃপক্ষ আর ট্রাফিক বিভাগের সমন্বয়ের অভাবে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতির প্রায় সবই এখন অকার্যকর।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিজস্ব অর্থায়নে ৫৩টি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (স্বয়ংক্রিয়) ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মহাখালী ও গুলশান-১ নম্বরে জাইকার অর্থায়নে দুটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপনের কাজ চলছে। এ দুটি সিগন্যাল চালুর পর সুফল মিললে পরে বাকি ইন্টারসেকশনগুলোতে নিজস্ব অর্থায়নে ট্রাফিক সিগন্যাল বসানো হবে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশনে দক্ষ পর্যাপ্ত লোকবল নেই। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, শুধু অত্যাধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বসালেই হবে না। এগুনো দেখভালের জন্য দক্ষ লোকবল লাগবে। ২০১৪ সালে ১৪জনকে এ বিষয়ে বিদেশে ট্রেনিং করানো হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে, পরে তাদেরকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখা হয়। তিনি বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপনের আগে এগুলো পরিচালনা এবং দেখভালের জন্য সিটি করপোরেশনগুলো যেন একটি প্রশিক্ষিত টিম গঠন করে। কারণ এগুলোর প্রতিদিনের কাজ। কোনো সিগন্যালে ত্রুটি দেখা দিলে যাতে নিজেরাই মেরামত করতে পারে সেই সক্ষমতা যেন নিজেদের থাকে। নতুবা ট্রাফিক সিগন্যালে ব্যয় করা জনগণের কোটি কোটি টাকা আগের মতোই জলে যাবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, হাতের ইশারায় সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণের কারণে অনুমান করেই ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়া হয়। এতে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। তিনি বলেন, স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থা কার্যকর করে তা ট্রাফিক পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকলে সমস্যা হতো না। ম্যানুয়ালি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে যন্ত্রের মাধ্যমে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা গেলে যানজটও অনেকটাই কমে আসবে।

সরেজমিনে গত সপ্তাহে একাধিক দিনে দেখা গেছে, ঢাকার ব্যস্ততম বিজয় সরণি সিগন্যাল। গুরুত্বপূর্ণ ৮টি সড়ক এসে মিশেছে এই সিগন্যালে। প্রতিটি সড়কের মুখে লাল সবুজ ও হলুদ বাতি জ্বলছে, নিভছে। ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে সিগন্যাল। আরেকটি ব্যস্ততম এলাকা কাকরাইল মোড়ের প্রতিটি সিগন্যাল বাতি ১৬০ সেকেন্ড পরপর সবুজ হয়ে ওঠে। কেউ হেঁটে বা যানবাহনে চড়ে এই সংকেত মানতে গেলে নিশ্চিত সমস্যায় পড়বেন। কারণ লাল বাতি জ্বললে চলছে যানবাহন, থেমে যাচ্ছে সবুজ বাতিতে। আবার বাতি থাকলেও তা জ্বলছে না। এমন চিত্র নগরীর প্রায় প্রতিটি সিগন্যালে (গুলশান-২ নম্বর সিগন্যাল বাদে)।

এ ছাড়া সোমবার রাত সাড়ে ১০টায় গাবতলীর টেকনিক্যাল মোড় সিগনালে দেখা যায়, মিরপুর থেকে গাবতলীর দিকে যাওয়া শতাধিক যান দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ বাতি জ্বললেও ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যাল ছাড়ছে না। অপেক্ষা করতে করতে কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়েন। প্রায় ৩০ মিনিটের মাথায় হাতের ইশারায় সিগন্যাল ছাড়েন ট্রাফিক পুলিশ। অছিম পরিবহণের চালক সাকিব যুগান্তরকে বলেন, ট্রাফিক পুলিশের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে কখন ছাড়বে সিগন্যাল।

এই সিগন্যালগুলো ছাড়াও সরেজমিনে কাওরান বাজার, ফার্মগেট, শাহবাগ, পল্টন, মৎস্য ভবন, বনানী, ধানমন্ডি-২৭, কাঁটাবন, বাটা সিগন্যাল, বাংলামোটর, মালিবাগ, শান্তিনগর, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন সিগন্যালে দেখা গেছে, কোথাও বাতি নেই, কোথায় বাতি থাকলেও জ্বলে না। আবার বাতি জ্বললেও এর কার্যকারিতা নেই। বলাকা, শিখর, বসুমতি, বিহঙ্গ, প্রজাপতি, রাজধানী, অছিম পরিবহনসহ বিভিন্ন পরিবহণের চালকের সঙ্গে কথা হলে তারা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, হাতের ইশারা দেখে গাড়ি চালাতে চালাতে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এমনকি ট্রাফিক পুলিশও এ কায়দায় অভ্যস্ত। তাই তারা কেউই সিগন্যাল বাতির দিকে তেমন একটা খেয়াল করেন না। তারা বলছেন, হাতের ইশারায় সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার কারণে যানজট দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে।

বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় প্রায় ২০ লাখ যানবাহনের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শুধু বাস রয়েছে প্রায় ৫ লাখ। মূলত গাড়িগুলো চলাচলের সময় হাতের ইশারায়ই নিয়ন্ত্রণ করছে ট্রাফিক পুলিশ।

ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, সারা ঢাকা শহরে ১১০টি পয়েন্টে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক বাতির ব্যবস্থা করা হলেও গুলশান-২ নম্বরে সিগন্যালে শুধু ওই ব্যবস্থাটি চালু রয়েছে। আর বাকি সকল পয়েন্টেই ট্রাফিক বাতিগুলো অকার্যকর।

সূত্র জানায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে একটি সিগন্যালও সক্রিয় নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ না করায় বেশিরভাগ ট্রাফিক বাতি নষ্ট হয়ে গেছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব খাদেম যুগান্তরকে বলেন, তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এরই মধ্যে কনসালট্যান্ট নিয়োগ করা হয়েছে। তারা সমীক্ষার কাজ করছেন। তিনি বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৩টি মোড়ে ইন্টেলিজেন্স ট্রাফিক সিস্টেম স্থাপন করা হবে। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে তা করার কথা রয়েছে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি সূত্র যুগান্তরকে জানায়, আগে প্রকল্পের মাধ্যমে সিগন্যালের কাজ করা হয়েছিল। সিগন্যালগুলোতে যেসব যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছিল এগুলো ভারত এবং চীন থেকে আনা হয়েছিল। যার গুণগত মান ততটা টেকসই ছিল না। আর এসব যন্ত্রপাতি মেরামত কিংবা চালানোর জন্য সিটি করপোরেশনের প্রশিক্ষিত কোনো লোকও নেই। যে কারণে এসব সিগন্যাল অকার্যকর হয়ে পড়ে।

এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোশেনের প্রধান নির্বাহী সেলিম রেজা বলেন, আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি একটা অত্যাধুনিক সিস্টেম চালু করতে। সেটা চালুর সঙ্গে সঙ্গে ম্যানুয়াল সিস্টেমটা বন্ধ হয়ে যাবে।

যোগাযোগ করা হলে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী নাঈম রায়হান খান যুগান্তরকে বলেন, জাইকার অর্থায়নে মহাখালী ও গুলশান এক নম্বরে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপনের কাজ চলছে। আগামী জুন মাস নাগাদ সিগন্যাল দুটির কাজ সম্পন্ন হবে। এই দুই সিগন্যালের কার্যক্রম সফল হলে অন্যান্য ইন্টারসেকশনে উত্তর সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে অত্যাধুনিক সিগন্যাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উত্তর সিটি করপোরেশনে সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার জন্য থাকা দুটি পদ ছিল। এ দুটি পদ এখন শূন্য রয়েছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমাদের এখানেই শুধু এই সমস্যা। পৃথিবীর কোথাও এ সমস্যা হয় না। কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয় ট্রাফিক সিগন্যালে। যারা টেন্ডার নেবে, কাজ পাবে তাদের সুবিধা। সেই ডিপার্টমেন্টের সুবিধা। এই সুবিধার জন্য মানুষের অসুবিধা হচ্ছে।

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম