মূল্যস্ফীতি : বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
আরও সতর্কতা জরুরি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সার্বিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা রক্ষায় মূল্যস্ফীতির হারের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ মুহূর্তে এটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, রীতিমতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জে রূপ নিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রায় সব দেশই বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে পণ্যমূল্য বাড়ায় এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার কারণেই মূলত দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। গত আগস্টে এ হার বেড়ে এযাবৎকালের মধ্যে রেকর্ড ছুঁয়েছে। ওই মাসে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে। অক্টোবরে আরও কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। শীতের সময়ে চাল ও সবজির সরবরাহ বাড়ায় পণ্যমূল্য কিছুটা কমে। এ কারণে শীতে একটু কমতে পারে। তবে শীতের পর এ হার আবার বেড়ে যেতে পারে-এমন আশঙ্কা যুগান্তরের কাছে পৃথকভাবে ব্যক্ত করেছেন দেশের তিনজন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ। এ হার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা
স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য আগাম পদক্ষেপ নিতে হবে: ড. এবি মির্জ্জা আজিজ
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকায় সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এখন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ধরে রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর পাশাপাশি সামজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো, রপ্তানির ধারাবাহিতা ধরে রাখাও চ্যালেঞ্জিং। কেননা বর্তমানে যে মূল্যস্ফীতি ঘটছে তার বড় কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক পরিস্থিতি। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এসব পণ্য আমদানি করতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বেড়েছে। অথচ এর আয় কমে গেছে। ফলে বাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। এতে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান পড়ে যাচ্ছে। এটি ধরে রাখাই এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এর পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রেমিট্যান্সে হুন্ডি বন্ধ করলে কিছুটা বাড়তে পারে। বৈদেশিক ভারসাম্য রক্ষায় এখন রেমিট্যান্স বড় কাজ দেবে। এ ছাড়া তিনি দেশের স্বল্প আয়ের মানুষকে দুর্যোগের আঘাত থেকে রক্ষা করতে সরকারকে আগাম পদক্ষেপ নিয়ে রাখতে হবে। কারণ মূল্যস্ফীতিতে বড় আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। এদের জন্য সরকারের সহায়ক সব ধরনের কার্যক্রম বাড়াতে হবে। এর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়াতে হবে। খাদ্য সহায়তা দিতে হবে। খাদ্য সহায়ক অন্য কার্যক্রমগুলোকেও চলমান রাখতে হবে। এগুলো যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায় সেদিকেও নজর রাখতে হবে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষকে সহায়তা দিলে তাদের ওপর মূল্যস্ফীতির আঘাতটা কমে আসবে। পরিস্থিতি যত দিন নিয়ন্ত্রণে না আসে তত দিন এসব সহযোগিতা দিতে হবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের দিকেও নজর রাখতে হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকলে মূল্যস্ফীতির আঘাত কিছুটা কম লাগে।
আগামী পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। আগামীতে আরও কমতে পারে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পূর্বাভাস দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলে দেশের আমদানি খাতে চাপ কমবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপও কমে যাবে। তখন বিনিময় হারেও স্থিতিশীলতা আসতে পারে। এতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সুফল আসবে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দেশের ভেতরেও যাতে পণ্যের দাম কমে সেদিকে নজর রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকারি তথ্য অনুযায়ী ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলে মূল্যস্ফীতির হার আরও কমে যেতে পারে। তবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দিকে সরকারকে নজর রাখতে হবে। কেননা দুর্যোগ যেকোনো সময়েই আসতে পারে। সে ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকারের প্রস্তুতি থাকতে হবে।
অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনায় মূল্যস্ফীতি বেশি হচ্ছে: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি এখন শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রায় সব দেশই সতর্কতা অবলম্বন করছে। বাংলাদেশকেও তাই করতে হবে। তবে বৈশ্বিক বা বিভিন্ন দেশের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিতে একটু ভিন্নতা রয়েছে। এদেশে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হচ্ছে মূলত অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে। পণ্যমূল্যে যেমন নিয়ন্ত্রণ নেই, তেমনই সেবা খাতেও নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বাড়া বা সরবরাহ সংকটের দোহাই দিয়ে পণ্য ও সেবার দাম লাগামহীনভাবে বাড়ানো হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রথমে বাজার নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। কিন্তু সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের মধ্যেও দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ বাড়ছে। এর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতেই তা বাড়ছে। আবার অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ও হচ্ছে। এর মানে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির উপকরণগুলো সঠিকভাবে কাজ করছে না। এ খাতে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। আর মুদ্রানীতি নিয়ে দেশের মূল্যস্ফীতির হার কমানো খুব বেশি সম্ভব নয়। এ হার কমাতে হলে বাজার ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। একই সঙ্গে পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহ বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে দেশে আমদানির মাধ্যমে এক ধরনের মূল্যস্ফীতি আমদানি করছে। এ প্রভাব থাকবে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমাতে হবে। এ খাতে আমদানি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাজারে কিন্তু বিলাসী পণ্যের সরবরাহে কোনো কমতি নেই। বিদেশি ফলের সরবরাহেও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু দাম বেড়েছে। বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে বেশি পণ্য আমদানি করে প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। ওইসব দেশে মূল্যস্ফীতির হার না কমা পর্যন্ত আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ থাকবে।
তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার নেপথ্যে আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। বিদেশ থেকে চড়া দামে পণ্য আমদানি করায় ও রেমিট্যান্স কমায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। এদিকে আমদানির দায় মেটাতে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু বাজারে ডলারের জোগান কমে গেছে। এতে টাকার মান কমে গিয়ে মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়াচ্ছে। কৃচ্ছ সাধনের জন্য জ্বালানির ব্যবহার কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও জ্বালানির ব্যবহার বেড়েছে।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আরও বড় ধরনের ধাক্কা আসবে। দীর্ঘ মেয়াদে এ হার বেশি থাকা বিপজ্জনক। মূল্যস্ফীতির বড় আঘাত আসে স্বল্প ও মধ্য-আয়ের মানুষের ওপর। তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের সুরক্ষা দিতে সরকারের সহায়ক কার্যক্রম আরও বাড়ানো জরুরি। এর মধ্যে কম দামে খাদ্য সরবরাহ করা। কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোয় নীতিসহায়তা দিয়ে চাঙা করে তোলা।
রিজার্ভ ব্যবহারে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল: ড. আহসান এইচ মনসুর
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির যে চাপ তার বেশির ভাগই বৈশ্বিক কারণে সৃষ্ট। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কিছু কারণও রয়েছে। বিশ্বব্যাপীই মূল্যস্ফীতির হারের ঊর্ধ্বগতিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারই বেশি বাড়ছে। এ হার আরও বাড়বে এমন আশঙ্কাও রয়েছে। বৈশ্বিকভাবে যে দুর্যোগ বা যুদ্ধবিগ্রহ দেখা দিলে মানুষের মধ্যে এ ধরনের আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়। এর সঙ্গে পণ্যের জোগানেও প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। এতে পণ্যে ও সেবার দাম বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি ঘটায়। এবারের মূল্যস্ফীতির নেপথ্যে বড় কারণ হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ না থামলে বৈশ্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম পড়বে না। বাংলাদেশ যেহেতু আমদানিনির্ভর, খাদ্য থেকে শিল্পের যন্ত্রপাতি কাঁচামাল আমদানি করতে হয়, সে কারণে এ দেশেও মূল্যস্ফীতির হার খুব বেশি কমবে না। আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি হবে।
মূল্যস্ফীতির ক্ষতির দিক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর প্রথম আঘাত আসে দরিদ্র মানুষের ওপর। এরপর মধ্য আয়ের মানুষের ওপর। তাদের আয় কমে যায়, পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এই দুই শ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তারা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য কিনতে পারে না। ফলে শিল্প উৎপাদনে ভাটা পড়ে। দেশের পুরো অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে সরকার বিপাকে পড়ে মুদ্রার মান কমে গেলে ও আমদানি ব্যয় বেড়ে গেলে সব খাতেই হিসাব-নিকাশে টান পড়ে। যেটি এখন পড়েছে। এখন উৎপাদন বাড়াতে হবে। এর মাধ্যমে আমদানির চাপ কমাতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, রিজার্ভ ব্যবহারে সরকারকে আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কেননা এখন রিজার্ভ বেশি থাকলে মুদ্রার মান এত বেশি হারে কমত না। আমদানি নিয়েও খুব বেশি দুশ্চিন্তা করতে হতো না।
তিনি বলেন, আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যে ঋণ পাওয়া যাবে তাতে বৈদেশিক লেনদেনের ওপর কিছু চাপ কমবে। এর পাশাপাশি সরকারকে রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। রপ্তানি বাড়ানো এখন চ্যালেঞ্জিং। তারপরও যতটুকু সম্ভব ধরে রাখতে হবে। এখন বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা কঠিন। তবে উন্নয়ন সহযোগীদের বরাদ্দ করা যেসব অর্থ পাইপলাইনে আটকে আছে, সেগুলোকে ছাড় করানোর উদ্যোগ নিলে ভালো হবে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে। যাতে আমদানি কম করতে হয়।