অর্থ সংকটে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ
ফেরত দেওয়া হচ্ছে প্রকল্প প্রস্তাব
দুই মাসে ফেরত গেছে ৩০টি প্রকল্প * এমটিটিবিএফ সীমা ও চাহিদার মধ্যে ব্যাপক ঘাটতি * কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য কঠোর হয়েছে পরিকল্পনা কমিশন- মামুন-আল-রশীদ
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অর্থ সংকটে ভুগছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। ফলে ফেরত দেওয়া হচ্ছে প্রকল্প প্রস্তাব। ২ মাসে ফেরত দেওয়া হয়েছে ৩০টির মতো প্রকল্পঅর্থ সংকটে ভুগছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। ফলে ফেরত দেওয়া হচ্ছে প্রকল্প প্রস্তাব। ২ মাসে ফেরত দেওয়া হয়েছে ৩০টির মতো প্রকল্প। । মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর (এমটিবিএফ) আওতায় বরাদ্দ শেষ হয়ে যাওয়ায় এসব প্রকল্প ফেরত গেছে। তবে বেশির ভাগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে কম গুরুত্ব বিবেচনা করা হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে মান নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে অর্থ সংকট কাটানোর ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনের যে উদ্যোগ, সেটিও পূরণ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এর আগে যুগান্তরকে বলেছিলেন, এমটিবিএফ-এর অর্থ হচ্ছে-প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের চলতি অর্থবছরের প্রকৃত বরাদ্দ উল্লেখ থাকবে। এর সঙ্গে পরবর্তী ৩ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দের প্রাক্কলন দেওয়া হয়। যাতে মন্ত্রণালয়গুলো তাদের ব্যয়ের সীমা মেনে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। এটি জাতীয় সংসদে অনুমোদন পাওয়া একটি নিয়ম। এমটিবিএফ সিলিং অমান্য করা কোনোভাবেই উচিত নয়। এতে একদিকে যেমন আর্থিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়, অন্যদিকে পরিকল্পনা শৃঙ্খলাপরিপন্থি কাজ হিসাবে গণ্য হয়। ফলে আরও আর্থিক সংকট দেখা দিতে পারে। জানতে চাইলে পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘এখন বিশেষ সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে। ফলে প্রকল্প প্রস্তাবগুলো কঠোরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। যেগুলো এখন বাস্তবায়ন না করলেও চলে সেগুলো ফেরত দেওয়া হচ্ছে’। আগে কেন কঠোরতা ছিল না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগে এমটিবিএফ সিলিং পার হলেও কিছু প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হতো। অর্থাৎ উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে গেলে কিছুটা বেশি কার্যক্রম হাতে নিতে হয়। সেই কৌশল থেকে এটা করা হতো। কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনুকূলে নয়। সেই সঙ্গে কৃচ্ছ সাধনের সরকারের নির্দেশনা আছে। সবকিছু মিলিয়ে প্রকল্প প্রস্তাব ফেরত দেওয়া হচ্ছে।’
সূত্র জানায়, প্রায় দুই মাসে যেসব প্রকল্প ফেরত দেওয়া হয়েছে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রকল্প ভৌত অবকাঠামো বিভাগের। এরপর আছে কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রকল্প। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা না করেই ফেরত যাওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ২১১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। চলতি বছর থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। প্রকল্পটিতে নানারকম সুপারিশ দিয়ে ফেরত দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ফেরত গেছে মেঘনার শাখা নদীর ভাঙন থেকে হিজলা উপজেলার পুরোনো হিজলা ও হরিনাথ এলাকা রক্ষা প্রকল্প। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৪৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। চলতি বছর থেকে শুরু হয়ে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কথা ছিল। আরও ফেরত গেছে ভবদহ ও তৎসংলগ্ন এলাকা জলাবন্ধতা দ্রুত নিরসন প্রকল্প। এটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪০ কোটি টাকা। ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলাধীন সুভাঢ্যা খাল পুনঃখনন এবং খালের উভয় পাড়ের উন্নয়ন ও সুরক্ষা, এটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। টাঙ্গাইল জেলার জেলা সদর, দেলদুয়ার ও মিঠামইন উপজেলাধীন লৌহজং নদী পুনঃখনন, এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ১২৫ কোটি টাকা। এছাড়া সুগন্ধা নদীর ভাঙন থেকে ঝালকাঠি জেলার সদর উপজেলা ও লৌহজং উপজেলার বিভিন্ন এলাকা রক্ষা প্রকল্প। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৯৮ কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার বিভাগের এমটিবিএফ বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ৮৯৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা। কিন্তু মোট চাহিদা ছিল ৭৪ হাজার ৪৯৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এ অর্থবছরে চাহিদা ও বরাদ্দে ঘাটতি আছে ৪০ হাজার ৫৯৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। এছাড়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটিবিএফ বরাদ্দ ৩৭ হাজার ২৮৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। চাহিদা হচ্ছে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৩৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ফলে চাহিদা ও বরাদ্দের ঘাটতি আছে ৭১ হাজার ৫০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বরাদ্দ ৪১ হাজার ১৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আর চাহিদা ৯৯ হাজার ৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ফলে ঘাটতি আছে ৫৭ হাজার ৯৯১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ ৪৫ হাজার ১১৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা, আর চাহিদা হলো ৬৮ হাজার ৯০৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে ঘাটতি থাকবে ২৩ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এ অবস্থায়ও বিভিন্ন নতুন প্রকল্প ও চলমান প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব পাঠাচ্ছে বিভাগটি। স্থানীয় সরকার বিভাগের মহাপরিচালক (পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন) ডা. মো. সারোয়ার বারী শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এ দায়িত্বে আমি নতুন এসেছি। তবে এটুকু বলতে পারি, এমটিবিএফ সিলিং-এর বাইরে যাতে প্রকল্প প্রস্তাব করা না হয় বিষয়টি আমি দেখব। এমটিবিএফ-এর বিষয়টি খেয়াল রাখা উচিত।
এছাড়া পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১০২টি প্রকল্পের অনুকূলে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে চাহিদা হচ্ছে ২২ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। এদিকে মন্ত্রণালয়টির এমটিবিএফ সিলিং হচ্ছে ৭ হাজার ৯৩৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরে চাহিদা ও এমটিবিএফ সিলিং-এর মধ্যে ঘাটতি আছে ১৪ হাজার ৫১৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ও চাহিদার মধ্যে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঘাটতি আছে ২ হাজার ১৮৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘাটতি আছে ১ হাজার ২৬৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এরকমভাবে অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এমটিবিএফ সিলিং-এর বেশি চাহিদা রয়েছে।