অত্যাধুনিক সমুদ্র বন্দর হবে পায়রা
বদলে যাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চল
বিলাস দাস, পটুয়াখালী
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সব প্রতিক‚লতা কাটিয়ে পায়রা বন্দর সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ১১টায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ১১ হাজার ৭২ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পগুলো উদ্বোধন করেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে ৪,৯৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নদী বন্দরের ক্যাপিটাল ড্রেজিং। ২০৯ দশমিক ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি পাইলট ভেসেল, দুটি হেভি ডিউটি স্পিডবোট, একটি বয় লেইং ভেসেল, একটি সার্ভে বোট এবং দুটি টাগবোটসহ আটটি জাহাজ প্রকল্প।
৪,৫১৬ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সমুদ্র বন্দরে টার্মিনাল নির্মাণ। ৬৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ছয় লেন বিশিষ্ট আধুনিক সংযোগ সড়ক নির্মাণ। ৭৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে রামনাবাদ নদীর ওপর ১ হাজার ১৮০ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতু নির্মাণ। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পায়রা বন্দর চালুতে আর কোনো জটিলতা থাকবে না। ২০২৩ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে বন্দরটি চালুর প্রত্যাশা করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। অনেকের মতে, এই বন্দর হবে বাংলাদেশের সচ্ছলতার প্রতীক।
২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার রামনাবাদ নদীর তীরে ৬ হাজার একর জমিতে দেশের তৃতীয় ‘পায়রা সমুদ্র বন্দর’ নির্মাণ প্রকল্প উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ পর্যন্ত আনুষঙ্গিক সুবিধা, টার্মিনাল নির্মাণ ও ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পে অনুমোদিত ব্যয় হয়েছে অন্তত ১৩৮০০ কোটি টাকা। কিন্তু নানা কারণে মাঝপথে বন্দর নির্মাণে টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায়।
যে কারণে একাধিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানে হতাশা নেমে আসে। কিন্তু ‘পদ্মা সেতু’ উদ্বোধনের পরই সুবাতাস বইতে শুরু করে পায়রা বন্দরে। এর আগে ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর কুয়াকাটা-ঢাকা মহাসড়কের পটুয়াখালীর পায়রা নদীর ওপর আধুনিক ডিজাইনে নির্মিত ‘পায়রা সেতুর’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী, যা বন্দরের পণ্য পরিবহণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পায়রা সমুদ্র বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, বন্দর সংলগ্ন নদীর নাব্য বজায় রাখতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প চলমান রয়েছে। পণ্য খালাসে পায়রা বন্দরে যে সুবিধা রয়েছে তা দেশের অন্য কোনো বন্দরে নেই। তাই দেশের অন্যান্য বন্দরের থেকে পায়রা বন্দর হবে উপযোগী ও আধুনিক বন্দর। এই বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্য স্বল্প সময় ও সহজ পদ্ধতিতে খালাস করে দেশের যে কোনো স্থানে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠাতে বিশেষ ভ‚মিকা রাখবে পদ্মা সেতু ও পায়রা সেতু। পদ্মা সেতুর হাত ধরেই আধুনিক ও অদ্বিতীয় বন্দরে রূপান্তরিত হবে পায়রা সমুদ্র বন্দর।
বন্দর সুত্র বলছে, এই বন্দরকেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে অনেকে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র“প অব কোম্পানি পায়রা বন্দর সংলগ্ন এলাকায় ৭শ একর জমি কিনেছে। মদিনা গ্র“প অব কোম্পানি ১০ একর জমি কিনেছে। এ ছাড়াও স্কয়ার গ্র“প অব কোম্পানিসহ একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের জমি রয়েছে এখানে। এছাড়াও ঢাকা-৮ আসনের এমপি হাজী সেলিম শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়তে জমিও কিনেছেন পায়রা বন্দর সংলগ্ন লালুয়া এলাকায়। এ ছোড়াও শতাধিক প্রতিষ্ঠানের সাইবোর্ড রয়েছে বন্দরকেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে।
পায়রা বন্দর প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ও পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনের এমপি আলহাজ মহিব্বুর রহমান মুহিব বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এই বন্দরের প্রতি আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ বেড়েছে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং সফল হলে বঙ্গোপসাগর থেকে সরাসরি পণ্যবাহী মাদার ভেসেল বন্দরের নিজস্ব টার্মিনালে নোঙ্গর করে পণ্য খালাস করতে পারবে। এতে লাইটারেজ জাহাজের প্রয়োজন হবে না।
তিনি বলেন, দেশের সচ্ছলতার প্রতীক হবে এই বন্দর। এ ছাড়াও পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা মাথায় রেখে পায়রা সমুদ্র সংলগ্ন রামনা নদীর তীরেই গড়ে তোলা হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প। কয়লাভিত্তিক এ মেগা প্রকল্পের চাহিদা মেটাতে পায়রা বন্দর সহায়ক হিসাবে কাজ করবে।
পটুয়াখালী পৌর মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, পায়রা বন্দর দক্ষিণাঞ্চল বদলে দেওয়ার চাবিকাঠি। বন্দর ছাড়াও পটুয়াখালী জেলা শহরের অদূরে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইপিজেড নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার।
নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, বর্তমানে কনটেইনার টার্মিনাল, বাল্ক টার্মিনাল, মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট,বিদ্যুৎ প্লান্ট, মডার্ন সিটি, বিমানবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলাসহ ১৯টি কম্পোনেন্টের কাজ চলমান রয়েছে। পাশাপাশি সর্বজনীন ও অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ অন্যান্য অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্যও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ উন্মুক্ত স্থান। ফলে কনটেইনার, বাল্ক, সাধারণ কার্গো, এলএনজি, পেট্রোলিয়াম ও যাত্রী টার্মিনাল নির্মাণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অঞ্চল, তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা, ওষুধ শিল্প, সিমেন্ট, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, সার কারখানা, তৈল শোধনাগার ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ আরও নানাবিধ কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
২০২৩ সালের মধ্যে পায়রা বন্দরকে বিশ্বমানের একটি আধুনিক বন্দর এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে অর্থনীতির সহায়ক শক্তি হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এসব উন্নয়ন কার্যক্রম দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গঠনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলস কাজ করছেন। যার ফলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ দেশ হবে বাংলাদেশ।