জাতীয় সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্ত
স্বতন্ত্র প্রসিকিউশনে অর্থ পাচার মামলা
অ্যাটর্নি সার্ভিস হলে মামলার সুফল পাওয়া যাবে-বিএফআইইউ’র সাবেক উপদেষ্টা
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পাচারকৃত অর্থ ফেরত ও অপরাধ শনাক্ত করতে মানি লন্ডারিং মামলা পরিচালনায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। রাষ্ট্রের একটি ইন্ডিপেডেন্ট প্রসিকিউশন সার্ভিস চালু করা হবে। এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সম্প্রতি ‘মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানান অর্থমন্ত্রী। এ কাজটি করবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং আইন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিএফআইইউ’র সংশ্লিষ্ট এক কর্তকর্তা জানান, অর্থ পাচার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থা এশীয় প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজি) কয়েক বছর আগে বাংলাদেশকে সতর্ক হিসাবে ধূসর তালিকাভুক্ত করেছিল। ওই সময় এপিজির কয়েকটি শর্তের মধ্যে একটি ছিল অর্থ পাচার মামলাগুলো পরিচালনার জন্য প্রসিকিউশন সার্ভিস চালু করা। পাশাপাশি এ সার্ভিস চালুর ব্যাপারে এর আগেও আইনমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়া ২০১৯ সালে অর্থ পাচারসংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির ২৫তম বৈঠকে সরকারের পক্ষে মানি লন্ডারিং মামলা পরিচালনার জন্য এ সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনোটি বাস্তবায়ন হয়নি।
বৈঠকে এর গুরুত্ব তুলে ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি পৃথক প্রসিকিউশন সার্ভিস রয়েছে। যার আওতায় দুদকের মামলাগুলো তাদের নিজস্ব আইনজীবী দ্বারা পরিচালিত হয়। ফলে মামলাগুলোর সফলতার হার বেশি। কিন্তু এমন সফলতার হার মানি লন্ডারিং নিয়ে কাজ করছে অন্যান্য তদন্ত সংস্থা যেমন- পুলিশ, কাস্টমস, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। সে ক্ষেত্রে দুদক ছাড়া অন্যান্য তদন্ত সংস্থায় ইন্ডিপেন্ডেট প্রসিকিউশন সার্ভিস চালু করতে পারলে মামলার সুফল পাওয়া যাবে।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য অর্থ পাচার মামলাগুলো পরিচালনায় ইন্ডিপেনডেন্ট প্রসিকিউশন সার্ভিস চালু করা একটি বেসিক কাজ। এটি গঠন করতে পারলে রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক এবং মামলার সুফল পাওয়া যাবে। বর্তমান রাষ্ট্রপক্ষ অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ দিয়ে এসব মামলা পরিচালনা করছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পর বা আগে সে নাও থাকতে পারে। এর জন্য তাকে কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না। ফলে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। কিন্তু পৃথক অ্যাটর্নি সেবা বা ইন্ডিপেন্ডেট প্রসিকিউশন সেবা চালু করতে পারলে মামলা পরিচালনার গতি আরও বাড়বে। কারণ সেখানে নিয়োজিত বিচারকের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা রাষ্ট্রের কাছে থাকবে।
এদিকে দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য বেরিয়ে আসছে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির প্রতিবেদনে। সংস্থাটির হিসাবে ২০১৬-২০ এ ৫ বছরে অর্থ পাচারের অঙ্ক ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এসব টাকা চলে গেছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডসহ ১০টি দেশে। আমদানি-রপ্তানিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারসাজি আর হুন্ডির আড়ালে এসব অর্থ পাচার হচ্ছে।
অর্থ পাচার ও পাচার প্রতিরোধ, এ সংক্রান্ত মামলা এবং সংশ্লিষ্ট আইনকে আরও শক্তিশালী করার বিষয়ে পর্যালোচনা করতে সম্প্রতি ‘মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ বৈঠক করেছে। তবে ২০১৯ সালে কমিটির শেষ বৈঠকটি হয়েছিল। এরপর করোনা মহামারি ও অন্যান্য কারণে বিগত তিন বছর এ কমিটির কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, আইন সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ সচিব, দুদকের চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, অ্যার্টনি জেনারেল, বিএফআইইউ’র প্রতিনিধি অংশ নেন।
জাতীয় সমন্বয় কমিটি মনে করছে, এ যাবতকালে সব পাচারের ঘটনা শনাক্ত সম্ভব হয়নি। তবে কিছু ঘটনায় অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কিন্তু এসব মামলাগুলোর বিপরীতে আসামিদের অপরাধ প্রমাণের হার খুব কম। কারণ পৃথক অ্যাটর্নি সেবা বা ইন্ডিপেন্ডেট প্রসিকিউশন সার্ভিস চালু না থাকায় অর্থ পাচার প্রতিরোধ এবং এ সংক্রান্ত মামলাগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা হচ্ছে না। এছাড়া মানি লন্ডারিং মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োজিত প্রসিকিউশররা অন্যান্য মামলায় সম্পৃক্ত থাকেন। আর এসব মামলার বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ না হওয়ার কারণে অধিকাংশ রায় সরকারের পক্ষে যায় না।
বৈঠকে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের সচিব মো. মইনুল কবির বলেন, ‘মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন একটি বিশেষ ধরনের অপরাধ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার প্রতিনিধির সমন্বয়ে পৃথকভাবে আলোচনা করে একটি কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করা উচিত।’ তিনি আরও বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে করা মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন অপরাধসংশ্লিষ্ট মামলা হতে নিম্ন আদালতের মাধ্যমে যেসব মামলার আসামি জামিন বা খালাস পায় সে মামলার মনিটরিং সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থাকেই করতে হবে।