চউকের পরিকল্পনা বিভাগ চলছে অপরিকল্পিতভাবে
১৪ বছরেও স্থায়ী প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ দিতে পারেনি সংস্থাটি * জেঁকে বসেছে দুর্নীতিবাজ চক্র
শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অনেকটা অপরিকল্পিতভাবেই চলছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) পরিকল্পনা বিভাগ। প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পরও এই বিভাগে একজন স্থায়ী প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ দিতে পারেনি সংস্থাটি। ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ দিয়েই বিভাগটি চলছে বছরের পর বছর। যে কারণে নগরীতে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র প্রদান, ভবন নির্মাণ, নকশা অনুমোদন, আবাসিক এলাকার লে-আউট অনুমোদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলছে স্থবিরতা ও দীর্ঘসূত্রতা। আবার এই বিভাগ থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত। এই সুযোগে পরিকল্পনা বিভাগজুড়ে জেঁকে বসেছে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ ও দালালচক্র। এই চক্র টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না। যার চরম খেসারত দিতে হচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের। সরেজমিনে চউকের পরিকল্পনা বিভাগে অনুসন্ধান করে অভিযোগের সপক্ষে বিস্তর তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে।
এদিকে বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের পদটি নিয়েও শুরু হয়েছে টানাহেঁচড়া। প্রধান প্রকৌশলী ও উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের মধ্যে টানাহেঁচড়ার কারণে তৃতীয় একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও চউক চেয়ারম্যানকে পাশ কাটিয়ে সেই দায়িত্ব বাগিয়ে এনেছেন ট্রুথ কমিশনে দুর্নীতির দায় স্বীকার করা একজন কর্মকর্তা। একসঙ্গে বর্তমানে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি এনে মন্ত্রণালয়েই যোগদানপত্র পাঠিয়ে এই পদে দায়িত্ব পালন শুরু করার ঘটনায় স্বয়ং চউক চেয়ারম্যানের মধ্যেও রয়েছে খানিকটা উষ্মা!
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৭-০৮ সালের দিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আখতার হোসেন নগর উন্নয়ন ও সেবা ত্বরান্বিত করতে চউকে আলাদা পরিকল্পনা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। তার সময়ে কল্পলোক আবাসিক, অনন্যা আবাসিক এলাকাসহ নগরীতে একাধিক আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠা হয়। তাছাড়াও নগরীর বিভিন্ন মোড় সম্প্রসারণ করে যানজট নিরসনেও ভূমিকা রাখেন এই চেয়ারম্যান। ওই সময়ে চউকের পরিকল্পনা বিভাগে একজন প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ দেওয়া হলেও তিনি ‘অনিবার্য’ কারণে এক মাসও ছিলেন না। পরবর্তী সময়ে প্রথম কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে আবদুচ ছালাম চউকের মতো প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ পান। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে ১০ বছরেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু দেখা যায়, এ দীর্ঘ সময়েও স্থায়ী প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্থপতি হিসাবে প্রকল্পের অধীনে নিয়োগ পাওয়া প্রকৌশলী শাহীনুল ইসলাম খান ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে কাজ চালিয়ে নেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি অবসরে যান।
চউক সূত্র জানায়, ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ অবসরে যাবেন, তাই স্থায়ীভাবে মাস্টার অব আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিংয়ের (এমইউআরপি) ওপর ডিগ্রিধারী এবং যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন একজন কর্মকর্তা চউকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখেন চউকের বর্তমান চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ। ওই চিঠিতেই উঠে আসে চউকের পরিকল্পনা বিভাগের ‘অপরিকল্পিত যাত্রার’ বিষয়গুলো।
চিঠিতে চউক চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, ‘রাজধানী ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটি বৃহৎ কর্তৃপক্ষ। যার ভৌগোলিক অধিক্ষেত্রের বর্তমান আয়তন ১১৫২ বর্গকিলোমিটার। এই বিশাল এলাকার মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন, ড্যাপ প্রণয়ন, সে মোতাবেক পরিকল্পনা প্রণয়ন, সংরক্ষণ, সুপারিশ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র প্রদান, ইমারত নির্মাণ নকশা অনুমোদন, যাবতীয় কার্যক্রম একজন প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান ২৬ ফেব্রুয়ারি অবসরজনিত ছুটিতে গেছেন।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘পরিকল্পনাসংক্রান্ত কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনার ওপর নির্ভর করে সিডিএ-এর সাফল্য ও প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম। বর্তমানে সিডিএতে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে (এমইউআরপি) তদূর্ধ্ব ডিগ্রিধারী একজন জ্যেষ্ঠ প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ বদলি কিংবা প্রেষণে না থাকায় প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা দিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কাজ চালাতে হচ্ছে। এতে উচ্চতর পেশাদারির অভাবে মাস্টার প্ল্যান ও ড্যাপ প্রণয়ন, সংরক্ষণ ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র প্রদান এবং ইমারত নকশা অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হচ্ছে। নাগরিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবা প্রদানও বিঘ্নিত হচ্ছে। ১১৫২ কিলোমিটার এলাকার নাগরিকদের বাড়ি, স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি, অনুমোদন প্রদান এবং পরিবীক্ষণ ও তদারকিসহ উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে কর্মকর্তাদের ওপর বর্তমানে বিপুল কাজের চাপ রয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জন্য একজন অভিজ্ঞ সুদক্ষ (সদস্য) পরিকল্পনা এবং একজন প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ বদলি কিংবা প্রেষণে পদায়ন করা একান্ত আবশ্যক। ’
এছাড়া পরিকল্পনা বিভাগের যাবতীয় কার্যক্রম সমন্বয়ের নিমিত্তে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৮-এর ৫(১), (খ), এবং ৭(১), (২) ধারার আলোকে পরিকল্পনা বিভাগের জন্য একজন সার্বক্ষণিক সদস্য নিয়োগের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বলা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি চউক চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণলায়ের সচিব বরাবরে এই চিঠি লেখেন।
সূত্র জানায়, ওই চিঠি মন্ত্রণালয়ে পড়ে থাকার সুবাদে উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা প্রকৌশলী আবু ঈসা আনসারী ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে দায়িত্ব পেতে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। তার বিষয়ে চউকের কাছে মতামত চাওয়া হলে চউক থেকে জানানো হয়, আবু ঈসা আনসারী ওই পদের যোগ্য নন। উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে ১৫ বছরের যে অভিজ্ঞতা দরকার তা তার নেই। চউকের প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) কাজী হাসান বিন শামসও আবু ঈসা আনসারীর বিষয়ে ভেটো দেন। এ অবস্থায় শাহীনুল ইসলাম খান অবসরে চলে গেলে চউকের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে দায়িত্ব দেন চউক চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ। এরই মধ্যে তিনি বিদেশ গেলে তার পরিবর্তে সমসাময়িক জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী হিসাবে মনজুর আহসানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (সিটিপি) হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। চউকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী রিং রোডের পিডি, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীসহ গুরুত্বপূর্ণ চারটি পদে থাকায় তাকে বাদ দিয়ে চউক চেয়ারম্যান ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে কাজ করতে মনজুর আহসানকে দায়িত্ব দেন।
সূত্র জানায়, এ অবস্থায় কাজী হাসান বিন শামস চউক চেয়ারম্যানকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের দায়িত্ব বাগিয়ে আনেন। সাধারণত মন্ত্রণালয় নিয়োগ দিলেও চউক থেকে এজন্য আলাদা চিঠি ইস্যু করা হয়। এটাই নিয়ম। মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে চউক পৃথক চিঠি বা অফিস আদেশ ইস্যু করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যোগদান করতে পারেন। কিন্তু কাজী হাসান বিন শামস মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়ে চেয়ারম্যানের পাশাপাশি মন্ত্রণালয়েও যোগদানপত্র পাঠিয়ে দেন। চউক থেকে চিঠি ইস্যুর আগেই তিনি দায়িত্ব পালন শুরু করেন নতুন পদে।
যদিও কাজী হাসান বিন শামস চেয়ারম্যানকে পাশ কাটিয়ে ‘তদবির করে’ ভারপ্রাপ্ত নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে নিয়োগ আনার অভিযোগটি সত্য নয় বলে দাবি করেন যুগান্তরের কাছে। দায়িত্ব নিতে না চাইলেও মন্ত্রণালয়ই তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে বলে জানান।
সেবাগ্রগীতাসহ ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই বিভাগে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদনেও গড়ে উঠেছে চক্র। যার কারণে সেবাগ্রহীতারা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। নগরীর মোহরা এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আবেদনকারী অভিযোগ করেছেন, ‘ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের (এলইউসি) জন্য তারা আবেদন করলেও দুই-তিন বছর পরও তারা এলইউসি পাননি। আবাসিক এলাকার অনুমোদন নেই-এমন অভিযোগে তাদের এলইউসি দেওয়া হচ্ছে না। আবার একই আবাসিক এলাকায় অনেককে এলইউসি দিয়েছে চউক। মূলত টাকাপয়সা না দেওয়ার কারণেই একই এলাকায় দুই আইন বাস্তবায়ন করছে চউকের পরিকল্পনা বিভাগ। এভাবে শত শত আবেদন আটকে আছে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘স্থায়ী প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ না থাকায় যেসব সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে তা জানিয়ে মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখেছিলাম। এরই মধ্যে কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য অথরাইজেশন, প্ল্যানিং ও বিশেষ প্রকল্পে অভিজ্ঞতা আছে মনজুর আহসান নামে এমন একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলীকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি মন্ত্রণালয়ে যোগদানপত্র দিয়ে কাজ শুরু করেছেন। চউক থেকে চিঠি ইস্যু করা পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি। যেহেতু মন্ত্রণালয় আমার উপরে; তাই এ বিষয়ে আমার করার কিছুই নেই।’
পরিকল্পনা বিভাগে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে চউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘লোকবল সংকটসহ নানা কারণে কিছু সমস্যা আছে। সবকিছু সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করছি আমি। নতুন অর্গানোগ্রাম বাস্তবায়নের চেষ্টাও করে যাচ্ছি। এ সংক্রান্ত একটি মামলা রয়েছে। মামলাটি নিষ্পত্তি করে লোকবল বাড়ানো এবং স্থায়ীভাবে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ নিয়োগের বিষয়ে প্রয়োজনে আবারও মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখব।’