সংলাপ বর্জনে থাকা ৯ দলের অভিমত
নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়
সংকটের একমাত্র সমাধান রাজপথ, আমরা সে প্রস্তুতিই নিচ্ছি -মির্জা ফখরুল
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শেষ হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপ। তবে এবারের সংলাপেও অংশ নেয়নি মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ নিবন্ধিত নয়টি রাজনৈতিক দল। অংশ না নেওয়ার যুক্তি তুলে ধরে এসব দলের নেতারা জানান, এ ইসি সরকারের আজ্ঞাবহ। তাদের পক্ষে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা আদৌ সম্ভব নয়। তাছাড়া তাদের সদিচ্ছা থাকলেও দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার মতো দুঃসাধ্য বা মেরুদণ্ড নেই। তাই ইসির সঙ্গে সংলাপ করে কোনো লাভ হবে না। তাদের মতে, আগে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুটি ফয়সালা হতে হবে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা এখন প্রমাণিত। তাই এই মুহূর্তে তাদের একমাত্র লক্ষ্য নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা। সেই সরকার এসে সিদ্ধান্ত নেবে-তারা কিভাবে নির্বাচন করবে।
নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। এরমধ্যে বিএনপিসহ ৯টি দল সংলাপে অংশ নেয়নি। বাকি ৮টি দল হলো বিএনপি, বাসদ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জেএসডি, এলডিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, সিপিবি ও বিজেপি।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রোববার যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। দেশবাসীও চায় না, এই নির্বাচন কমিশন বা সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হোক। প্রধানত এ কারণেই আমরা এই কমিশনের কোনো সংলাপ, আলোচনা বা ইভিএম নিয়ে মন্তব্য করছি না। কারণ আমরা বিশ্বাস করি না এই নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। সরকার যদি পরিবর্তন না হয়, নিরপেক্ষ সরকার যদি না আসে, তাহলে এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। যদি স্বর্গ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়ে আসেন তাহলেও বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু করতে পারবেন না।
তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করবেন বলে ইসি নানা কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু উনারা যত কথাই বলুক, লাভ নেই। আসল প্রশ্নটা হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার। সেই সরকার যদি আওয়ামী লীগ থাকে এবং শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রী থাকেন, তাহলে কোনোমতেই সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যে সংকট তার একমাত্র সমাধান রাজপথ। আমরা এখন সে প্রস্তুতিই নিচ্ছি। আমাদের সঙ্গে আরও অনেককে দেখতে পাবেন।
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয়নি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। এ প্রসঙ্গে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, আগামী দ্বাদশ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার প্রশ্নেই জরুরি। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী দলীয় সরকার ক্ষমতায় রেখে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবে না। ফলে সরকারের অধীন ও অধীনস্থ থেকে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত ‘রোডম্যাপ’ ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনের সংলাপ পাতানো নির্বাচনের নাটক। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনকে দলীয় সরকার তার অধীন ও অধীনস্থ করে ফেলে। তাই প্রবল ক্ষমতাতন্ত্রের বিপরীতে শুধু নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা বা আন্তরিকতা দিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তাই নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় সভার কোনো মতামত বা অভিমত সামনে রেখে বিদ্যমান অবস্থায় সুষ্ঠু ভোট করার সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক বলেন, এ নির্বাচন কমিশন অনেক কথা বলছে। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পরই তারা ব্যর্থ হয়েছে। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে তাদের অসহায়ত্ব জাতি দেখেছে। তারা যে সরকারের আজ্ঞাবহ সেটাই প্রমাণ হয়েছে। সরকারি দল তাদের পছন্দের লোকদের কমিশনে বসিয়ে মনগড়া ফরমায়েশি নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছে। তাদের সঙ্গে সংলাপ করে কোনো লাভ নেই। আমরা যে পরামর্শ বা মত দেই না কেন দিনশেষে তারা সরকারের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় দলনিরপেক্ষ সরকার ছাড়া একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান কখনও সম্ভব নয়। আমরা সেই লক্ষ্যেই আন্দোলন করছি। আমাদের আন্দোলনের যথার্থতা ও যৌক্তিকতা দেশবাসীসহ বিশ্ববাসীর সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়েছে। আন্দোলনের মাধ্যমেই সেই সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ইসির সংলাপে না যাওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করবে অথচ সুনির্দিষ্ট কোনো এজেন্ডা ছিল না। নির্বাচনি আইন, বিধি সংস্কার ও আধুনিক যন্ত্র ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচনকে স্বচ্ছ করার কথা চিঠিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমরা এরসঙ্গে একমত নই। দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত নির্বাচন কেমন হয়েছে, নির্বাচনি আইনসহ সার্বিক বিষয় তাদের অবহিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেগুলো বোঝার আগেই তারা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। এতে কি আউটপুট আসবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। তাদের বক্তব্য নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। আজকে যা বলছে, কাল সেখান থেকে সরে আসছে। এর বাইরে সংলাপে অংশ না নেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, আমরা ২০১১ ও ২০১৭ সালে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে কিছু প্রস্তাবনা দেই। কিন্তু তারা আমাদের প্রস্তাবনাগুলো কোনো গুরুত্ব দেয়নি। কেন প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করেনি তা একটি চিঠি দিয়েও জানায়নি। আমরা আগের কমিশনের কাছ থেকে ন্যূনতম সৌজন্যবোধ পাইনি। এমনকি বর্তমান কমিশনের কাছেও প্রস্তাবনা দিয়েছি। কিন্তু কোনো জবাব দেয়নি। আমরা মনে করছি, ইসির এ সংলাপ আনুষ্ঠানিকতা, শুধু সময় নষ্ট। তাই সবকিছু বিবেচনা করে আমরা সংলাপে যাইনি।