পদ্মা সেতুতে রেলের কাজ শুরু হতে বিলম্ব
ঢাকা-যশোর লাইনে মূল প্রকল্পে নজর
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ১৫ মে ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
পদ্মা সেতুর উপর রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরুর অনুমোদন পেতে বিলম্ব হচ্ছে। ঢাকা-যশোর রেললাইন স্থাপনের মূল প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজে এখন নজর দিচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ। পরিকল্পনা ছিল সেতুসহ দুপাশে ৪০ কিলোমিটার লাইন স্থাপন করে একই দিনে সড়ক-যানের সঙ্গে ট্রেনও চলবে। কিন্তু জুনে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে, ফলে রেল আর এ পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে পারছে না।
জানা গেছে, প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ঢাকা-যশোর পর্যন্ত লাইন স্থাপন শুরু না করে সেতুর দুপাশে ৪০ কিলোমিটার লাইন স্থাপনের কাজ পুরোদমে শুরু করে ২০১৮ সালে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল সেতু দিয়ে একই দিন সড়ক-যানের সঙ্গে ট্রেনও চলবে। সেই নির্দেশনা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত লাইন স্থাপন কাজ পুরোদমে চলছিল।
এখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেতুর উপর কিংবা সেতুর দুপাশে লাইন স্থাপন করতে হবে-এমন চ্যালেঞ্জ আর রইলো না। অপরদিকে রেলপথ বিভাগ বরাবর দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, সেতু কর্তৃপক্ষকে মাসে ১০৬ কোটি টাকা ভাড়া প্রদান করতে হবে। এ নিয়ে রেলওয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। আজ পদ্মা সেতু এলাকায় পরিদর্শন করতে যাচ্ছেন রেলপথমন্ত্রী, রেলপথ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এদিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখন বলছে, জুনে পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে। এখনও মূল সেতুতে লাইন বসানোর অনুমোদন পাওয়া যায়নি। জুলাইয়ে অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সেতুর লাইন বসাতে সময় লাগবে প্রায় ৮ মাস। এতে একই দিন সড়ক-যানের সঙ্গে ট্রেন চালানো স্বপ্নেই রয়ে গেল। রেলের অভিযোগ, মূল সেতুর রেললাইন বসাতে প্রায় ১ বছর ধরে সেতু কর্তৃপক্ষ বরাবর অনুমোদন চেয়ে আসছিল রেলওয়ে কর্তৃক্ষ। কিন্তু, সেতু কর্তৃপক্ষ কাজের অনুমোদন দেয়নি। ফলে মূল প্রকল্প উপেক্ষা করে নেওয়া ৪০ কিলোমিটার লাইন স্থাপনে যে চ্যালেঞ্জ ছিল, তা কাজে এলো না। বরং প্রতিশ্রুতি রক্ষায় দ্রুত কাজ করতে গিয়ে পিলার ত্রুটিসহ নানা সমস্যায় পড়তে হয় রেলকে। বর্তমানে শুধু ৪০ কিলোমিটার নয়, পুরো প্রকল্পে নজর বাড়াচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি সেতু কর্তৃপক্ষ রেলপথ বিভাগ বরাবর বিশেষ এক চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, সেতু দিয়ে ট্রেন চালাতে হলে প্রতি মাসে ১০৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ভাড়া (ট্যারিফ) দিতে হবে সেতু কর্তৃপক্ষকে। একই সঙ্গে জানানো হয়েছে, সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত হার অনুযায়ী ৩৫ বছর এ ভাড়া দিতে হবে। প্রতি বছর টোলের হার ভিন্ন হবে। কিন্তু ৩৫ বছরে ৬ হাজার ২৫২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ভাড়া হিসাবে সেতু কর্তৃপক্ষকে প্রদান করতে হবে রেলকে।
এ বিষয়ে শনিবার বিকালে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘সেতু দিয়ে ট্রেন চললে নিশ্চয় ভাড়া প্রদান করতে হবে। এজন্য নিয়ম অনুযায়ী যে ভাড়া আসবে তা পরিশোধ করতেই হবে। আমরা ভাড়ার তালিকা রেলকে দিয়েছি। আর সেতুতে রেললাইন স্থাপন বিষয়টি নিয়ে যে কথাবার্তা হচ্ছে, তা যথাযথ নয়। কারণ, আমাদের সেতুতে কাজ চলমান অবস্থায় কোনো অবস্থাতেই রেলকে লাইন স্থাপনের অনুমোদন দিতে পারি না। কোনটার পর কোনটা কাজ করতে হবে, সেই নিয়মেই আমরা কাজ করছি। একটার পর একটা কাজ করতে হয়। ওই অবস্থায় রেল কাজ করার সুযোগ পাবে না। উভয়পক্ষ একমত হয়েছি, সেতুতে দুপক্ষ কাজ করার সুযোগ নেই। এরপরও রেল বারবার পত্র দিচ্ছে, কাজের অনুমোদন চেয়ে। তবে আমরা রেলকে সম্প্রতি জানিয়েছি জুলাইয়ের কোনো এক সময় অনুমোদন দেব। এটাও নিশ্চিত করা বলা হয়নি, সম্ভাব্য সময় বলা হয়েছে।’
শনিবার পদ্মা রেল লিংক সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. আফজাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর কাজ করতে আমাদের একটি আনুমানিক সময় জানানো হয়েছে। সেতু কর্তৃপক্ষ বলেছে, জুলাইয়ের কোনো এক সময় কাজের অনুমোদন দেবে। সেতুতে কাজের অনুমোদন চেয়ে আসছি প্রায় ১ বছর ধরে। যে দিনই অনুমোদন দেওয়া হোক, অনুমোদনের পর ৬ থেকে ৭ মাস সময় লাগবে সেতুতে লাইন বসাতে। এটা নিশ্চিত যে, আমরা সেতু উদ্বোধনের দিন ট্রেন চালাতে পারছি না। আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল, চ্যালেঞ্জ ছিল একই দিন ট্রেন চালানো। এজন্য বিশেষভাবে মূল প্রকল্পের ৪০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে দ্রুত কাজও চলছিল। সেতুর দুপাশে লাইনও স্থাপন হয়েছে। মূল সেতুর সঙ্গে কাজের সমন্বয় না হওয়ায় আমরা লাইন স্থাপন করতে পারিনি। এখন পুরো প্রকল্পে পুরোদমে কাজ চলছে। এছাড়া সেতু কর্তৃপক্ষ রেলের কাছে যে ভাড়ার কথা বলেছে, তা প্রদান করা সম্ভব কিনা তা জানা নেই।
সেতু কর্তৃপক্ষের দেওয়া পত্রের জবাব দ্রুত সময়ের মধ্যেই দেব জানিয়ে প্রকৌশলী আফজাল হোসেন বলেন, ‘সেতু দিয়ে ট্রেন চালুর মাস থেকেই প্রতি মাসে ১০৬ কোটি টাকা প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। আমরা যতটুকু জানি যমুনা সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন চলাচল করায় প্রতি মাসে ১ কোটি টাকার মতো টোল প্রদান করা হয়। আর পদ্মায় প্রায় ১০০ গুণ বেশি টাকা চাওয়া হচ্ছে। আমাদের এখন চিন্তা, দ্রুত সময়ের মধ্যে পুরো প্রকল্প ধরে কাজ করা। জুলাইয়ে যদি অনুমোদন দেয় তাহলে আগস্ট থেকে সেতুতে লাইন বসানোর কাজ শুরু হবে। প্রথমে জাজিরা প্রান্ত থেকে সেতুতে কাজ শুরু হবে। ১ মাস পর মাওয়া প্রান্ত থেকে সেতুতে কাজ শুরু হবে। জাজিরায় প্রায় আড়াই কিলোমিটার লাইন বসানো হয়েছে বাকি আছে আরও ১ কিলোমিটার। মাওয়ায় দেড় কিলোমিটার লাইন বসানো হয়েছে। কেরানীগঞ্জ এলাকায় প্রায় ৪ কিলোমিটার উড়ন্ত লাইন স্থাপন করা হয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার, একই বছরের আগস্টের মধ্যে মাওয়া থেকে ঢাকা পর্যন্ত লাইন স্থাপন সম্পন্ন করা হবে। ২০২৪ সালের মধ্যে ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত লাইন স্থাপন সম্পন্ন করা হবে।
রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, রোববার (আজ) সেতু এলাকায় তারা পরিদর্শন করতে যাবেন। ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক হবে। সেতু দিয়ে একই দিন ট্রেন চালানো সম্ভব না হলেও, আমরা পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। একই দিন সড়ক-যানের সঙ্গে ট্রেন চলবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়েই কাজ চলছিল। এখন নিশ্চিত যে, একই দিন সেতু দিয়ে ট্রেন চলছে না। সেতুতে কাজ করার অনুমোদন পেলে, দ্রুততার সঙ্গে সেতুতে লাইন স্থাপন করা হবে। জুলাইয়ে অনুমোদন পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর রেলের কাছে যে ভাড়ার কথা পত্রের মাধ্যমে জানানো হয়েছে, তা নিয়ে আমরা বৈঠক করব। সেতু কর্তৃপক্ষ যে ভাড়া চাচ্ছে তা রেল কিভাবে দেবে, তা নিয়েও আলোচনা হবে। আমরা সেতু কর্তৃপক্ষকে চিঠির মাধ্যমে জানাব।