সব আমলেই উপেক্ষিত তিন জোটের রূপরেখা
গণতন্ত্রে ফেরা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর করাসহ অনেক দিকনির্দেশনা ছিল
আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্ষমতা ছেড়েছেন ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। ওই সময় সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রধানত তিনটি জোট ছিল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামপন্থিদের নেতৃত্বাধীন পৃথক ওই জোট তখন পরিচিতি পায় ‘তিন জোট’ হিসাবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলাকালে তিন জোট একটি রূপরেখা তৈরি করে।
পরবর্তী সরকারব্যবস্থা কেমন হবে-সেটাই ছিল রূপরেখার মূলকথা। সেই রূপরেখা সম্পর্কে দেশের নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগই এখন জানে না। শুধু তা-ই নয়, রাজনীতিসচেতন মানুষের মধ্যেও অনেকে ওই রূপরেখার কথা ভুলে গেছেন। কারণ, রূপরেখায় বর্ণিত বেশির ভাগ অঙ্গীকার পরবর্তী সরকারগুলোর সময় মানা হয়নি। এ কারণে জনমনে সেটি ঢাকা পড়ে গেছে।
গণতন্ত্রে ফেরা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর করাসহ অনেক দিকনির্দেশনা ছিল সেই রূপরেখায়। সেই মূল অঙ্গীকারের অনেকটাই এখন উপেক্ষিত। আন্দোলনে যুক্ত রাজনীতিকরা বলছেন, তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কারণেই সেই পথ রুদ্ধ হয়েছে।
গণতন্ত্রকে প্রকৃত অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের লক্ষ্য এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ভিন্ন কৌশলে জন্ম হয়েছিল এক-এগারোর মতো পরিস্থিতির। এখন নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি দেশের মানুষের যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা তিন জোটের রূপরেখা উপেক্ষিত হওয়ার কারণেই।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সাতদলীয় জোটের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ছিলেন বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব বর্তমানে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সোমবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘তিন জোটের রূপরেখায় নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার উল্লেখ ছিল। কিন্তু সংবিধান সংশোধন করে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দিয়েছে। তারা দেশের পবিত্র সংবিধান ধ্বংস করে দিয়েছে। সংবিধানে প্রদত্ত জনগণের মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনকে আজ তারা ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। কী হবে আর তিন জোটের রূপরেখা নিয়ে কথা বলে?’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, যুগপৎ আন্দোলনে এরশাদ সরকারের বিদায়ের পর বিএনপি ক্ষমতায় এসে তিন জোটের রূপরেখাকে উপেক্ষা করে। তারা (বিএনপি) জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়ে তিন জোটের রূপরেখার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ’৯৬ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন করেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণে বঙ্গবন্ধুকন্যার সংগ্রাম এখনো চলছে। কাজেই তিন জোটের রূপরেখা বিএনপি উপেক্ষা করলেও আওয়ামী লীগ তা বাস্তবায়ন করেছে।
তিন জোটের রূপরেখা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তৎকালীন পাঁচ দলের নেতা, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘নব্বইয়ে এরশাদের পতনের আগে আমরা তিন জোটের রূপরেখা ঘোষণা করি। গণতান্ত্রিক পথে যাত্রায় এই রূপরেখার আংশিক সাফল্য এসেছে। বিএনপি সহযোগিতা করলে পুরোপুরি সফলতার দিকে যাওয়া যেত।’
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে আবার গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যে কথা রূপরেখায় বলা হয়, এর উল্লেখ করে জাসদ সভাপতি বলেন, ’৯১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এই ধারাটি অস্বীকার ও লঙ্ঘন করে। হাসানুল হক ইনু বলেন, তিন জোটের রূপরেখার সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফেরার জন্য সার্বভৌম সংসদের ভোট। কয়েকটি কালো আইন বাতিল অন্যতম সাফল্য বলে তিনি মনে করেন।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন অসীম কুমার উকিল। বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক তিনি। অসীম কুমার উকিল যুগান্তরকে বলেন, তিন জোটের রূপরেখা পুরোপুরি অর্জিত হয়েছে-এটা বলা যাবে না। এটা সময়সাপেক্ষ একটা ব্যাপারও। তবে আমি হতাশ নই। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যা করে যে ধারার সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই তিন জোটের রূপরেখার প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরতে লড়াই করতে হচ্ছে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা সম্ভব হয়েছে। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠনের দাবি বাস্তবায়িত হয়েছে। তিন জোটের রূপরেখায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ পৃথককরণ এবং স্বাধীন বিচার বিভাগের উল্লেখ ছিল, যা আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে (১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আট দল, বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল এবং বামপন্থিদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ দল মিলে এরশাদ-পরবর্তী সরকারব্যবস্থা কী হবে, এর একটি রূপরেখা তুলে ধরে। ওই রূপরেখাকে তখন জাতীয় সনদ বলা হতো। দুই সপ্তাহ পর ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দেন। মৌলবাদ ও একনায়কতন্ত্র যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে প্রত্যয় ছিল রূপরেখায়। ছিল নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। রূপরেখায় জাতীয় সংসদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ভোটারদের ইচ্ছামতো ভোট দেওয়ার বিধান নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথাও বলা ছিল রূপরেখায়।
রূপরেখায় তিনটি জোটভুক্ত দলগুলো ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করে। জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেবে না এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সমবেতভাবে প্রতিরোধ করবে মর্মে সমঝোতায়ও পৌঁছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত তখনকার প্রধান তিনটি জোট।
সরকারের চিহ্নিত সহযোগী ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের তাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোয় স্থান না দেওয়ার অঙ্গীকারও করে তারা। কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আগের সরকারের অন্যতম সহযোগী সাবেক আমলা এমকে আনোয়ার পান বিএনপির মনোনয়ন। পরবর্তী সময়ে বিএনপিতে যোগ দেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহারও শুরু হয় ’৯১ সাল থেকে, যা পরবর্তী সময়ে ভোট টানার অন্যতম কৌশলে পরিণত হয়।
বিএনপির আমলে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোর ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চলে আসে মুখোমুখি অবস্থানে। এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন।
এ ব্যবস্থা মেনে নেয়নি আওয়ামী লীগ। ফলে তাদের মিত্র ১৪ দলকে নিয়ে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। এই পরিস্থিতিতে আসে এক-এগারোর মতো শাসনব্যবস্থা। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। আদালত পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দিলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সে পরামর্শ না শুনে নিজেদের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছে।
জানতে চাইলে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের ছাত্রনেতা নুর আহমদ বকুল বলেন, তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চালু আজও সম্ভব হয়নি। বৈষম্য অনেক বেড়েছে। মানুষের ভোটের অধিকার আবারও হারিয়ে গেছে। দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠার বদলে লুটেরা রাজনীতি তথা লুটপাট ও শোষণের অর্থনীতি চালু হয়েছে। এক দল জামায়াতের সঙ্গে, আরেক দল হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত করে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, যা তিন জোটের রূপরেখার চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের অন্যতম নেতা ছিলেন তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ফয়জুল হাকিম লালা। তিনি এখন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক। সাবেক ছাত্রনেতা লালা সোমবার যুগান্তরকে বলেন, তিন জোটের রূপরেখা কেন বাস্তবায়ন হয়নি, এর উত্তর আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাদেরই দিতে হবে।
তিনি বলেন, কিছু কালো আইন বাতিল হলেও স্বাধীনভাবে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ হয়নি। ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী-আমলারা পাজেরো চালিয়ে এসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছ থেকে নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে এমপি হয়ে সংসদে বসে গলাবাজি করছে। ফলে গণতান্ত্রিক শক্তির ওপর ভিত্তি করে যে সরকার গঠন হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি।