
প্রিন্ট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১১ এএম
এলাকামুখী মনোনয়নপ্রত্যাশীরা
জমজমাট ঈদ রাজনীতি
দিচ্ছেন ঈদ উপহার, অংশ নিচ্ছেন নানা কর্মসূচিতে * ভোটারদের কাছে জানান দিচ্ছেন নিজেদের উপস্থিতি

হাবিবুর রহমান খান ও হাসিবুল হাসান
প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
দেশ থেকে উধাও করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা। সবকিছুই এখন স্বাভাবিক। এ সুযোগে রাজনীতিও ফিরেছে পুরোনো রূপে। বিগত দুই বছর পর ঈদকেন্দ্রিক রাজনীতি এবার জমজমাট। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এলাকামুখী হচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী, এমপিসহ মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। বসে নেই বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারাও।
নিজ নিজ এলাকার নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। দিচ্ছেন ঈদ উপহার। ইফতার পার্টি, গণসংযোগ, উঠান বৈঠক, চা-চক্রসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। বিভিন্ন এলাকায় চোখে পড়ছে ঈদের শুভেচ্ছা সংবলিত পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন।
নিজেকে জানান দিতে ব্যবহার করছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফরমও। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দাঁড়াচ্ছেন গরিব ও অসহায় মানুষের পাশে। ইতোমধ্যে অনেকে নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে জাকাতের কাপড়, নগদ টাকাসহ ঈদসামগ্রী তুলে দিয়েছেন দুস্থদের হাতে। কেউ কেউ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যারা এলাকায় ঈদ করেননি, তারাও এবার বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেকে ইতোমধ্যে নিজ এলাকায় ঘুরে এসেছেন। ঈদের ছুটিতে আবারও যাবেন। এজন্য এলাকার প্রবেশমুখ বা বিমানবন্দর না হয় রেলস্টেশনে নেতাকে যাতে ফুলের মালা দিয়ে স্বাগত জানানো হয়, তা স্থানীয় নেতাকর্মীদের আগাম বলে দেওয়া হচ্ছে। নেতার গাড়ির সামনে-পেছনে যেন মোটরসাইকেল এবং ট্রাকবহর থাকে, সে ব্যবস্থা করতে বলা হচ্ছে।
নেতার আগমন নিয়ে ঈদের সময় এলাকায় মানুষের মুখে মুখে যেন আলোচনা থাকে, সে কারণে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ঢাকায় বসেই এসব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে দিচ্ছেন অনেক নেতা। এজন্য স্থানীয় নেতাকর্মীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও থাকছে বলে জানা গেছে। তবে দীর্ঘদিন নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের খোঁজখবর না নেওয়ায় হঠাৎ মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তৎপরতা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
তৃণমূল নেতাকর্মীরা জানান, এতদিন তারা কোথায় ছিলেন। করোনায় মানুষের কাজকর্ম বন্ধ ছিল। অনেকে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছে। চরম দুঃসময়ে নেতাদের কেউ কাছে পায়নি। এমনকি তারা নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ফোনও রিসিভ করেনি। সেই নেতারা হঠাৎ করে এমন দরদি হয়ে গেলেন।
নির্বাচন সামনে রেখে পোড় খাওয়া নেতাদের চেয়ে সুবিধাবাদীদের আনাগোনাই বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। ঢাকায় বসে এ ধরনের বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে তারাই আবার ফিরে আসছেন। এলাকাবাসীর কাছে নিজেকে মেলে ধরতে ব্যস্ত।
খোঁজ নিয়ে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগামী দ্বাদশ নির্বাচনের আগে আর মাত্র একটি ঈদুলফিতর রয়েছে। তাই এবারের ঈদকে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচনায় নিয়েছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। এলাকায় নিজের অবস্থান পাকা করতে আগ থেকেই এবার ঈদের মাঠে রয়েছেন নেতা, এমপি-মন্ত্রী ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে ঈদ উদ্যাপনের প্রস্তুতিও চলছে। দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য উপহারের তালিকাও তৈরি করে ফেলছেন অনেকে। গত চার ঈদ করোনার কারণে যে ভাটা পড়েছে, সেটি এবার পূরণের চেষ্টা চলছে। নির্বাচনের আগে কেন্দ্রকে আকৃষ্ট করতে নিজেদের অবস্থান অনেকেই জানান দিচ্ছেন। ভোটারদের কাছে নিজেকে তুলে ধরতে ঈদকে বেছে নিয়েছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা।
প্রতিবছর ঈদে আওয়ামী লীগসহ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, বিদেশি কূটনীতিক, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গত দুই বছর ঈদ উৎসবে গণভবনে আনুষ্ঠানিক কর্মসূচিও ছিল না।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ফোনে ও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। এছাড়া গত দুই বছরের চার ঈদে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং এমপি-মন্ত্রীদের বড় একটি অংশকে ঢাকায় অবস্থান করতে দেখা গেছে। তবে অনেকেই আবার নিয়মিত এলাকায় যোগাযোগ রেখেছেন। করোনার মধ্যেও গিয়েছেন নির্বাচনি এলাকায়। করোনারোধী সামগ্রী ও ত্রাণসহ বিভিন্ন উপহার বিতরণ করেছেন সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীদের মধ্যে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্তত ৫-৬ জন নেতা গত সপ্তাহে তাদের নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। এছাড়া সম্পাদকমণ্ডলী ও কার্যনির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকজন নেতাও রোজার মধ্যে নিজ নিজ এলকা থেকে ঘুরে এসেছেন।
এমপি ও মন্ত্রীদের বেশির ভাগই রোজায় প্রতি সপ্তাহে এক-দুইদিন নিজ নির্বাচনি এলাকায় সময় দিয়েছেন। সেখানে তারা ইফতার পার্টি, দলীয়সহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী, নেতা ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বেশির ভাগই ঈদ এলাকায় করবেন বলে জানা গেছে। যারা ঈদের দিন যেতে পারবেন না, তারা ঈদের আগে বা পরে সময় করে যাবেন এলাকায়।
বিএনপির সিনিয়র নেতারাও অনেকেই নিজ নিজ এলাকা ঘুরে এসেছেন। তবে মাঝারি সারির নেতা বিশেষ করে যারা আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন চান, তাদের বেশির ভাগই এবার নির্বাচনি এলাকায় যাচ্ছেন। যোগ দিচ্ছেন ইফতার পার্টিতে। দলের পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে নেতাকর্মীরা সক্রিয় রয়েছেন।
কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করছেন। ঈদ সামনে রেখে কেন্দ্রীয় নেতারা আরও সক্রিয় হচ্ছেন। অনেকেই ঈদের দিন এলাকায় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শুধু কেন্দ্রীয় নেতা নন, মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক ব্যবসায়ী, সুবিধাবাদী নেতাও ছুটছেন এলাকায়। ঈদ উপহারের নামে দিচ্ছেন নগদ টাকা। এলাকায় নিজ একটা বলয় তৈরির চেষ্টা করছেন।
ক্ষমতার দাপট, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বউ, ছেলে-মেয়ে, ভাইদের অপকর্ম, বিএনপি-জামায়াতসহ ভিন্নপন্থিদের দলে অনুপ্রবেশের সুযোগ তৈরিসহ নানা অভিযোগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হন প্রায় অর্ধশত এমপি। এসব স্থানে উঠে আসে নতুন মুখ। এদিকে পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক স্থানে পালটে যায় স্থানীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট। দলের দায়িত্বশীল নেতা ও সাধারণ কর্মীরাও ভিড়তে শুরু করে নতুন এমপির কাছে। অভিমানে নিজ নির্বাচনি এলাকায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেলেন অনেকেই। এর মধ্যে করোনা তাদের এই দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়।
তবে দিন যতই গড়াচ্ছে, ততই বর্তমান এমপিদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক প্রভাবশালী নেতা গত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছিলেন। এরপর থেকে অনেকটাই এলাকাবিমুখ তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে তিনি বলেন, এলাকায় গেলে বর্তমান এমপি আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন। আমি গেলে আমার কিছু কর্মী, সমর্থক দেখা করতে আসে, পরে জানতে পারি তাদের নানাভাবে নাজেহাল করা হয়। এ কারণে এলাকায় যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম। এখন আবার এলাকামুখী হচ্ছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার সব সময়ই যোগাযোগ ছিল। কখনই দূরত্ব ছিল না। আমি অবশ্যই আমার এলাকার মানুষের কাছে যাব।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, মহামারি করোনার কারণে গত দুই বছর ঈদে আমরা সেভাবে মানুষের কাছাকাছি যেতে পারিনি। তবে এই সময়ে আমরা নানা কর্মসূচি নিয়ে সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছি। এবার করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। ফলে আসন্ন ঈদুলফিতর আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ঈদ সামনে রেখে আমরা এলাকায় যাচ্ছি। দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের খোঁজখবর রাখছি।
বিএনপির যুগ্মমহাসচিব খায়রুল কবির খোকন যুগান্তরকে বলেন, করোনা মহামারির কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নেতাকর্মীদের সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ রাখতে পারেনি। বিশেষ করে এলাকায় গিয়ে একসঙ্গে বসার সুযোগ ছিল না। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি উন্নত হওয়ায় এবার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি দেখা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ঈদের আগে যোগাযোগ বেড়ে গেছে। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে কেন্দ্রীয় নেতারা নিজ নিজ এলাকায় যাচ্ছেন। দলীয় অসহায় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি গরিব ও অসহায়দের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। ঈদকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে একটা সেতুবন্ধ তৈরি হবে বলে মনে করেন তিনি।