২২টির বিরুদ্ধে চলছে তদন্ত
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ডুবছে দুর্নীতিতে
তিনটির প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে * কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে -ড. বিশ্বজিৎ চন্দ, ইউজিসির সদস্য
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
আর্থিক, প্রশাসনিক ও একাডেমিক অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইনে ‘অলাভজনক’ হলেও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ আয়ের মেশিনে পরিণত হয়েছে। সেই অর্থ নিয়েই চলছে লুটপাট। সিন্ডিকেট-একাডেমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে চলার কথা এসব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিগত অফিসের মতো চালাচ্ছেন কেউ কেউ। এমন নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ২৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
এ বিষয়ে জানার জন্য ইউজিসি সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দের সঙ্গে যুগান্তরের কথা হয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন উৎস থেকে প্রায় দুই ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিছু অভিযোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আর কিছু সরাসরি ইউজিসিতে জমা পড়ে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে চিঠি পাওয়া গেছে। সেগুলো আমলে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটির তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে গেছে। প্রতিষ্ঠান হিসাবে সেগুলো টেকার কথা নয়।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বেশির ভাগই আর্থিক। এছাড়া বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দ্বন্দ্ব, অবৈধভাবে চাকরিচ্যুতি, উপাচার্যসহ কর্মকর্তাদের বেতনভাতা না দেওয়ার ঘটনাও আছে। শিক্ষক সংকট, এমনকি সনদ বাণিজ্যের মতো অভিযোগ আছে।
তদন্তের মুখোমুখি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি। যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের সূত্র ধরে গত বছরের ১ আগস্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তিন সদস্যের কমিটিকে প্রথমে ১৬ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে পরে কমিটি ৪৫ দিন সময় চেয়ে নেয়। কিন্তু এর মধ্যেও ওই কমিটি তদন্তকাজ শেষ করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে কমিটির আহ্বায়ক ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, মাঠে নেমে আরও অনেক কিছুই পাওয়া যাচ্ছে, যা তদন্তের মূল বিষয় আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের মধ্যে পড়ে। এজন্য একটু সময় লাগছে। তবে শিগগিরই প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
জানা যায়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বেশুমার অভিযোগ। মূল অভিযোগের মধ্যে আছে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোটা অঙ্কের সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি কিনে তা ব্যবহার, সমালোচনার মুখে পড়ে তা ফেরত দেওয়া, ভর্তিবাণিজ্য প্রভৃতি।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ১২ বছর চ্যান্সেলর নিযুক্ত কোনো উপাচার্যের মুখ দেখেনি। মালিকই উপাচার্য হিসাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। এটা অনেকটা পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ছিল অভাবনীয় সংখ্যক সনদ ইস্যুর অভিযোগ। এ কারণে একবার প্রতিষ্ঠানটির সমাবর্তন বর্জন করেছিলেন চ্যান্সেলর।
ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (ইউএসটিসি) প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম। বর্তমানে তার তিন সন্তানের মধ্যে এ প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নিয়ে বিরোধ চরমে। একসময় অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী এখানে লেখাপড়া করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যমান অবস্থায় বিদেশিদের পাশাপাশি দেশি শিক্ষার্থীরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বিভিন্ন অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি হয়েছে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে নেই চ্যান্সেলর নিযুক্ত কোনো উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কোর্স, শিক্ষাক্রম প্রভৃতি আধুনিকায়ন না করার অভিযোগ আছে। এভাবে আরও কিছু অভিযোগ উঠেছে, যা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি কাজ করেছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে লেখাপড়া করছেন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। যাদের অনেককে অননুমোদিত আসনে ভর্তি করা হয়েছে। মানিকগঞ্জের এনপিআই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব, জুনিয়র শিক্ষক দিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনাসহ বেশকিছু অভিযোগ আছে। প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া কারও কারও বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়টির টাকা আত্মসাতের অভিযোগও আছে। সম্প্রতি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষকের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি চিহ্নিত হয়। কিন্তু তারা আছেন বহাল তবিয়তে। ফরিদপুরের টাইমস ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো পরিবেশই নেই বলে ইউজিসির সাম্প্রতিক এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে। ওই প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশও ছিল। কিন্তু এখনো কার্যক্রম চলছে। এরপর আরও কিছু অভিযোগ ওঠায় তা তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একইভাবে চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটিও আরেক প্রতিবেদনে ইউজিসি বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়টিও আইনের অনেক শর্তই পূরণ করছে না বলে অভিযোগ এসেছে।
এভাবে সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি, পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লার ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটি, সিলেটের নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, খুলনার নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা এবং আমেরিকান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির (আমবান) বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। এগুলোর মধ্যে প্রথম তিনটির তদন্ত শেষ হয়েছে। পরবর্তী ব্যবস্থার জন্য প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ার বিরুদ্ধে একবার মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ ওঠে। এছাড়া আরও বেশকিছু অভিযোগের তদন্ত ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান নিজেই করেন। ওই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ ছিল সেই তদন্ত প্রতিবেদনে। এই প্রতিষ্ঠান আবারও তদন্তের মুখে পড়েছে।