কলম্বো বন্দরে কনটেইনার জটের প্রভাব দেশের আমদানি-রপ্তানিতে
ইউরোপ-আমেরিকায় পণ্য পাঠাতে ৪-৫ দিন বেশি সময় লাগছে
মজুমদার নাজিম উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শ্রীলংকার কলম্বো বন্দরে সংকটের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানির একটা বড় অংশ হয়ে থাকে কলম্বো ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর ব্যবহার করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেখা দিয়েছে তীব্র জ্বালানি সংকট। কলম্বো বন্দরে কনটেইনার পরিবহণে ব্যবহৃত ভারী যানবাহন চলাচল কমে গেছে জ্বালানির অভাবে। এ কারণে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ বন্দরে দেখা দিয়েছে কনটেইনার ও জাহজ জট। সেই জটে পড়ে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় পণ্য পাঠাতে বাড়তি সময় লাগছে ৪-৫ দিন। একইভাবে রপ্তানিতেও লাগছে বেশি সময়। এ জট দিনদিন বাড়ার কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশের নৌবাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা।
তারা জানান, কলম্বো বন্দরের জট দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি সংকটের মুখে পড়বে। বিদেশি ক্রেতাদের কাছে সময়মতো পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হবে না। আমদানি পণ্য আসতেও হবে বিলম্ব। সবকিছু মিলিয়ে পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খলে বিপর্যয়ের আশঙ্কাও রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমদানি-রপ্তানিকারকদের অনেকে চট্টগ্রাম-কলম্বোর বিকল্প রুট খুঁজছেন। এক্ষেত্রে তারা ভারতের বন্দর হয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় পণ্য আনা-নেওয়া করা যায় কি না চিন্তাভাবনা করছেন।
নৌবাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি পণ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ এবং রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশ হয়ে থাকে কলম্বো বন্দর ব্যবহার করে। চট্টগ্রাম বন্দরে সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের বড় কনটেইনার জাহাজ ভিড়তে পারে না। এখান থেকে ফিডার (মাঝারি আকারের) জাহাজে করে কলম্বো, সিঙ্গাপুর, পোর্ট কেলাং ও তানজুম-পেলিপাস বন্দরে কনটেইনার নেওয়ার পর সেখানে অবস্থানরত মাদার ভেসেলে (বড় আকারের জাহাজ) বোঝাই করে ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলোয় পাঠানো হয়। আমদানিও হয় একইভাবে। সিঙ্গাপুর বন্দরের চেয়ে কলম্বো হয়ে পণ্য পরিবহণে সময় তিন-চার দিন কম লাগে। তাই এ রুটটিতে আমদানি-রপ্তানকারক ও শিপিং এজেন্টদের আগ্রহ বেশি। চট্টগ্রাম থেকে রপ্তানি পণ্য কলম্বোয় পৌঁছাতে এবং খালাসের পর পুনরায় সেখানকার মাদার ভেসেলে লোড করতে সাধারণত ৮-৯ দিন সময় লাগে। কনটেইনার জট সৃষ্টি হওয়ায় বর্তমানে এ কাজে আরও ৪-৫ দিন সময় বেশি লাগছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলংকার অবস্থা এখন টালমাটাল। দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট। কলম্বো বন্দরে কনটেইনার পরিহবণে ৪০০-৫০০টি লরি (ভারী যান) ব্যবহৃত হতো। এখন জ্বালানির অভাবে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ কারণে বিপুলসংখ্যক কনটেইনার জমে গেছে। ফিডার ভেসেল থেকে খালাস করে কনটেইনার মাদার ভেসেলে বোঝাই করতে তাই লাগছে অতিরিক্ত সময়।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ যুগান্তরকে বলেন, শ্রীলংকার আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন খাত। করোনাসহ নানা কারণে দেশটি এখন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে কলম্বো বন্দরে। জ্বালানি সংকটে ওই বন্দরের অর্ধেকসংখ্যক লরি চলছে না। কনটেইনার মুভমেন্ট হচ্ছে কম। এ কারণে বন্দরটিতে এখন দেখা দিয়েছে কনটেইনার জট। এতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যে ফিডার জাহাজগুলো ওই বন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া করে, সেগুলো লোডিং-আনলোডিংয়ে সময় বেশি লাগছে।
তিনি জানান, শুরুতে তা ২-১ দিনে থাকলেও এখন ৪-৫ দিনে ঠেকেছে। এই বাড়তি সময় জাহাজকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এ কারণে ইউরোপ, আমেরিকার ক্রেতাদের কাছে যথাসময়ে পণ্য পৌঁছানো যাচ্ছে না। পুরো বিষয়টি একটি চেইনের মতো। এক জায়গায় সংকট দেখা দিলে এর প্রভাব অন্য জায়গায় পড়তে বাধ্য। শিগগিরই অবস্থার উন্নতি হবে-এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বরং দিনদিন জট বাড়ছে। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে বড় সংকট দেখা দিতে পারে।
সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ আরও জানান, এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটের তেমন একটা বিকল্প নেই। কারণ সিঙ্গাপুর বন্দরেও প্রচুর জাহাজ ও কনটেইনার রয়েছে। বিকল্প হিসাবে আছে ভারতের বন্দর। তবে এখানকার বন্দর বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিকারকরা সচরাচর ব্যবহার করেন না। তাই কলম্বো বন্দরের সংকট কেটে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
চট্টগ্রাম-ইতালি সরাসরি চালু হওয়া নতুন রুট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই রুটে পর্যাপ্ত জাহাজ চালু হয়নি। তাছাড়া দেশের আমদানি-রপ্তানিকারকরা এখনো রুটটিতে অভ্যন্ত হয়ে উঠেননি। এই রুটের ভাড়া অনেক বেশি। করোনার কারণে জাহাজ ভাড়া প্রায় চার গুণ বেড়ে গেছে। সেই হিসাব করে কেউ কেউ এখন বাড়তি খরচেও রুটটি ব্যবহার করছেন। যদি ভাড়া কমে যায় বা আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, তাহলে বেশি ভাড়ায় আমদানি-রপ্তানিকারকরা পণ্য পরিবহণে হয়তো রাজি হবেন না। তাই এই রুট কতটুকু সফল হবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।