গোপালগঞ্জে ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার ৬
ধর্ষকরা চুরি-ছিনতাইয়েও জড়িত * উত্ত্যক্ত ও ঝগড়া বাধিয়ে মারধর * শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ আন্দোলন অব্যাহত
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে শনিবার প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান -যুগান্তর
গোপালগঞ্জে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকায় ছয়জনকে র্যাব গ্রেফতার করেছে। শুক্রবার রাতে গোপালগঞ্জের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসবাদে তারা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। বুধবার গোপালগঞ্জ শহরের হেলিপ্যাড এলাকায় তারা প্রথমে ওই ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত ও অশালীন কথাবার্তা বলে এবং তার বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া বাধায়। এর প্রতিবাদ করায় বন্ধুকে মারধর এবং ওই ছাত্রীকে তুলে নিয়ে তারা সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। শনিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব এসব তথ্য জানায়।
রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে শুক্রবার রাতে গোপালগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো-রাকিব মিয়া ওরফে ইমন (২২), পিয়াস ফকির (২৬), প্রদীপ বিশ্বাস (২৪), নাহিদ রায়হান (২৪), মো. হেলাল (২৪) ও তূর্য মোহন্ত (২৬)। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে গোপালগঞ্জ সদরের নবীনবাগ হেলিপ্যাডের সামনে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী ও তার বন্ধু হেঁটে মেসে যাওয়ার সময় কতিপয় দুর্বৃত্তের (গ্রেফতার) মুখোমুখি হন। নবীনবাগ হেলিপ্যাডসংলগ্ন এলাকায় যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তরা ইজিবাইক থামিয়ে ওই ছাত্রী ও তার বন্ধুর নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করে। এ সময় তারা বিভিন্ন ধরনের অশালীন মন্তব্য ও ইভটিজিং করে। এর প্রতিবাদ করায় জোর করে ঘটনাস্থলের পাশে ঢালু জায়গায় তাদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। এতে তারা বাধা দেন। এ সময় বন্ধুকে মারধর এবং ওই ছাত্রীকে স্থানীয় একটি ভবনে নিয়ে ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় বশেমুরবিপ্রবির প্রক্টর বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে গোপালগঞ্জ সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। চাঞ্চল্যকর ও আলোচিত এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৮ এর অভিযানে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেফতার রাকিব মিয়া ওরফে ইমন স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম সম্পন্ন করেছে। স্থানীয় একটি ক্লিনিকে রিসেপশনিস্ট হিসাবে সে চাকরি করে। তার বিরুদ্ধে মাদক ও মারামারির মামলা রয়েছে। একটি পাওয়ার হাউজে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে পিয়াস কাজ করে। হোম সার্ভিসের মাধ্যমে প্রদীপ এসি ও ফ্রিজ মেরামতের কাজ করে। স্থানীয় কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নাহিদ ও হেলাল। মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ডিস্ট্রিবিউশন সেলস অফিসার হিসাবে হেলাল চাকরি করে। খুলনার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৮ সালে ডিপ্লোমা করে তূর্য। এরপর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ার জন্য সে বিদেশ যায়। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে শেষবর্ষে থাকাকালে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সে দেশে চলে আসে। এরপর সে গোপালগঞ্জে সদরে গার্মেন্ট পণ্য নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। তার বিরুদ্ধে একটি মারামারির মামলা রয়েছে। নবীনবাগ হেলিপ্যাড এলাকায় তারা নিয়মিত জুয়া খেলত, আড্ডা দিত। এবারই তারা ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে তারা পেশাদার অপরাধী। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। স্থানীয় একটি অপরাধী চক্রের সদস্য তারা। এর নেতৃত্বে ছিল রাকিব মিয়া। তূর্য মোহন্ত ছাড়া এ চক্রের অন্য সদস্যরা ৮-১০ বছর ধরে নবীনবাগ এলাকার বিভিন্ন স্থানে মাদকসেবন, আড্ডা, জুয়া, চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত ছিল। ঘটনার দিনও তারা হেলিপ্যাড এলাকায় মদের আসর বসিয়েছিল। তারা বিভিন্ন সময় রাস্তাঘাটে স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করত। তবে ভুক্তভোগী ও তার বন্ধু অপরাধীদের চিনত না।
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গ্রেফতার রাকিব গোপালগঞ্জের মিয়াবাড়ি এলাকার সাফায়েত মিয়ার ছেলে। এছাড়া বাবুল ফকিরের ছেলে পিয়াস ফকির, চাঁন মিয়ার ছেলে হেলাল, হরিজন পল্লির পরেশ বিশ্বাসের ছেলে প্রদীপ, নবীনবাগের ওহিদুজ্জামানের ছেলে নাহিদ এবং বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাটের মৌপুরা গ্রামের তূর্য।
এদিকে পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নির্যাতিত ছাত্রীর চিকিৎসা ও শারীরিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এরপর আদালতে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। তাকে পরিবারের হেফাজতে পাঠানো হয়েছে।
বশেমুরবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ : বশেমুরবিপ্রবি ছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। শনিবার সকালে প্রশাসনিক ভবনের সামনে তারা অবস্থান নেন। এরপর মাথায় কালো কাপড় বেঁধে তারা মিছিল করেন। এ সময় তারা ধর্ষকদের ফাঁসি দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন। বিকাল ৪টার দিকে ছাত্রীহলগুলোতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়। এছাড়া শিক্ষক সমিতির ডাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গোপালগঞ্জ-পাটগাতী সড়কে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা।
বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব বলেন, গোপালগঞ্জে ধর্ষকদের কোনো জায়গা নেই। ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছে। আমি বিশ্বাস করি আমাদের যৌক্তিক দাবির প্রতি স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোপালগঞ্জের মানুষের সমর্থন রয়েছে। এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য ধর্ষকদের এমন শাস্তি হতে হবে যা সারা দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। এ সময় বক্তব্য দেন বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান, আইন অনুষদের ডিন ও প্রক্টর ড. রাজিউর রহমান, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. কামরুজ্জামান, বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মহিলা হলের প্রভোস্ট বাঁধন মনি, শেখ রাসেল হলের প্রভোস্ট ফায়েকুজ্জামান মিয়া, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি শামসুল আরেফিন, শিক্ষক সমিতির প্রচার সম্পাদক ড. সাদ্দাম হোসেন প্রমুখ।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বশেমুরবিপ্রবি ছাত্রীর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছেন। প্রতিবাদ সমাবেশে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। খুলনা ব্যুরো জানায়, বশেমুরবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ এবং অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে খুলনার সাধারণ শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছেন। শনিবার নগরীর শিববাড়ী মোড়ে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে খুলনার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আশপাশের জেলা ও বিভাগের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।