Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ব্যক্তি পর্যায় ঋণের ৪১৯ কোটি টাকা লোপাট

ছোট প্রকল্পে ‘পুকুরচুরি’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইইএফ: ঋণ নিয়ে আত্মগোপন, অস্তিত্বহীন প্রকল্পের নামে টাকা উত্তোলন, অন্য প্রতিষ্ঠানে টাকা স্থানান্তর, সরকারি খাসজমি মর্টগেজ রেখে ঋণ

Icon

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ছোট প্রকল্পে ‘পুকুরচুরি’

ছোট ছোট প্রকল্পে ‘পুকুরচুরি’ হওয়ার মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইকুইটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনারশিপ ফান্ডের (ইইএফ) ঋণকে কেন্দ্র করে ঘটেছে এই ঘটনা। এ ফান্ড থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে ঋণ নিয়ে শতাধিক কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্পের অন্তরালে ৪১৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ঋণের অর্থ তুলে আত্মগোপন, অস্তিত্বহীন প্রকল্পের নামে টাকা উত্তোলন, অন্য প্রতিষ্ঠানে ঋণের অর্থ স্থানান্তর, সরকারি খাসজমি মর্টগেজ দেওয়াসহ নানা কৌশলে মোটা অঙ্কের এই অর্থ লোপাট করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব অপকর্মের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কতিপয় কর্মকর্তা জড়িত। আইসিবির মাধ্যমে ইইএফ ঋণ বিতরণ করা হয়।

সরকারি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ইইএফ ঋণের নানা অপকর্মের উল্লিখিত চিত্র। সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, সিএজির (বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল) মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. হারুন অর রশিদ মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, ইইএফ ঋণ জালিয়াতি নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয়ের প্রতিনিধি ছিলেন। এসব ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের শনাক্ত করতে বলা হয়েছে। দায়ী প্রমাণ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিএজি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা যায়, ইইএফ থেকে ৪১৯ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে ১০৪টি ছোট প্রকল্পের নামে। এসব প্রকল্প কৃষি ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক। লুটপাটের ধরনে দেখা যায়, পটুয়াখালীর বাউফলে সরকারি খাসজমিতে মাত্র ৩৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ৪ কোটি টাকার ঋণ আত্মসাৎ করে আলতাব ফিশিং। ঋণ নেওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইসিবির কতিপয় কর্মকর্তা অবৈধ সুবিধা নিয়ে উদ্যোক্তার পক্ষে সরেজমিন অসত্য প্রতিবেদন দেয়। শুধু তাই নয়, এই কোম্পানি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিনব কৌশল হিসাবে কাগজেপত্রে নতুন একটি কোম্পানি সৃষ্টি করে আরও ৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। কোম্পানির নাম আ কে ফুডস এবং কাগজে-কলমে কোম্পানির নাম আ কে কমোডিটিজ। কাগজে-কলমে সৃষ্টি কোম্পানির নামে কেনা ২৯ লাখ টাকার জমির মূল্য অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এ উদ্যোক্তার পক্ষে অসত্য প্রতিবেদন দেওয়া হলেও ওই সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কোনো শাস্তিও হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত টাকা তুলে প্রকল্প চালুর জন্য কোনো যন্ত্রপাতি আমদানি না করেই বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এছাড়া কক্সবাজারের রামুর রাজ মৌজার দাগ নং- ২১৭৭, ২১৮৮ ও ২১৮৯ খতিয়ানের জমির মিউটেশন ও খাজনার দলিল ভুয়া হিসাবে শনাক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রামু উপজেলার ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) জানান, উল্লিখিত খতিয়ান এই অফিস কর্তৃক সৃজন হয়নি। এছাড়া খতিয়ানের দাখিলকৃত ডকুমেন্ট ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের যে স্বাক্ষর রয়েছে, সেটি ভুয়া। অথচ কক্সবাজার হ্যাচারিজ অ্যান্ড ফিসারিজ এভাবে জালজালিয়াতি করে সাড়ে চার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ইইএফ-এর।

অপর ঘটনায় বগুড়ার শিবপুর, আদমদীঘির শারীব অ্যাগ্রো সার উৎপাদনের নামে প্রায় ৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। তাদের সার ব্যবস্থাপনা আইন-২০০৬ অনুযায়ী উৎপাদন, বিপণন, আমদানি, সংরক্ষণ, বিতরণের নিবন্ধন না নিয়ে ঋণের টাকা তুলে নেয়। শেষ পর্যন্ত টাকা নিয়ে উৎপাদনে না গিয়ে প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়।

মেসার্স ফ্লেমিংগো অ্যাগ্রোটেক আলু থেকে পাউডার স্টার্চ উৎপাদনের জন্য ইইএফ থেকে ৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছে। আইসিবির পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এ প্রকল্প উৎপাদনে যাচ্ছে এবং রপ্তানি শুরু করবে। পরে এই প্রতিবেদন দেখিয়ে ইইএফ থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্প চালু করা হয়নি। পরে আইসিবির ইইএফ রিকভারি টিম গিয়ে জানতে পারে, আগের পরিদর্শন প্রতিবেদন সত্য ছিল না।

লুটপাটের অপর ঘটনায় পটেটো ফ্লাক্স বিডি নামের প্রতিষ্ঠান পটেটো ফ্লাক্স উৎপাদনের জন্য প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে। কিন্তু পরে আইসিবির টিম পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায়, সে কারখানায় পটেটো ফ্লাক্স উৎপাদন হচ্ছে না। অন্য একটি কোম্পানি বিস্কুট কারখানা দিয়েছে। আবার পাটোয়ারি পটেটো ফ্লাক্সকে পটেটো ফ্লাক্স বানাতে ঋণ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই কারখানাও বন্ধ পায় আইসিবির পরিদর্শন টিম। এই তিনটি ঘটনায় মাধ্যমে ইইএফ থেকে সোয়া ১৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এই পাটোয়ারি পটেটো ফ্লাক্স অন্য একটি স্থানে ৬ একর জমি ১২ লাখ টাকায় কিনে ক্রয়মূল্য প্রদর্শন করেছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। ওই জমি দেখিয়ে ঋণ নিয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৩ কোটি টাকা মালিক আব্দুল আওয়াল পাটোয়ারি ও শাহ আলমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়।

লুটপাটের ঘটনায় আরও দেখা যায়, জমির মিউটেশন জাল বানিয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাতক্ষীরার হ্যাচারি সিটি অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স। এই প্রকল্পের প্রকৃত সত্য গোপন করে ঋণ পাইয়ে দিতে সরেজমিনে পরিদর্শনের মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অসাধু এক কর্মকর্তা। এখন প্রকল্প বন্ধ হওয়ায় টাকা আদায় অনিশ্চিত।

এছাড়া আইসিবির প্যাড, সিল ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে জুপিটার আইটি লি. অস্তিত্বহীন প্রকল্পে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। উদ্যোক্তাকে এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উদ্যোক্তাদের খুঁজে না পাওয়া ও অস্তিত্বহীন প্রকল্পের তালিকায় আরও আছে গানকি লি. এবং ইনসার্ট সফটওয়্যার অ্যান্ড সার্ভিস লি.। এ দুই প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণের অর্থ অনত্র স্থানান্তর করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, হোসাইন হ্যাচারি অ্যান্ড পোলট্রি কমপ্লেক্স, সালমান ফিশারিজ, প্রেজান্টার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, কোয়ালিটি এ্যাকুয়া কালচার, বলেশ্বর হ্যাচারি অ্যান্ড ফিশারিজ লিমিটেড, অঞ্চল অ্যাগ্রো প্রসেসিং, আইজেন সফটওয়্যার লিমিটেড, রিসোর্সেস টেকনোলজি, আল সরদারনী ফুড লিমিটেড বন্ধ আছে। এ ধরনের আরও ৫৯ প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। এসব প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে ১৭৫ কোটি টাকা।

সিএজি প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ জালিয়াতি করেছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-নোয়াখালী অ্যান্ড ফুড লিমিটেড ৫২ কোটি, দ্যা ডিকোড ৯ কোটি, কোয়ালিটি মিল্ক প্রোডাক্ট প্রায় ৯ কোটি, রিয়ার অ্যাগ্রো প্রিজার্ভিং সাড়ে ৪ কোটি, ইরিনা অ্যাগ্রো ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ ও গ্রিন গোল্ড অ্যাগ্রো প্রোডাক্ট ১৩ কোটি, সূর্যনগর ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স ও সূর্যভিটা অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স প্রায় ১০ কোটি, ছোঁয়া অ্যাগ্রো প্রোডাক্ট লিমিটেড সাড়ে ৪ কোটি, কোয়ালিটি অ্যাগ্রো ফরেস্ট লিমিটেড ১৭ কোটি, লালমনিরহাটে ফিশারিজ, হ্যাচারি অ্যান্ড ফিড লিমিটেড প্রায় ৬ কোটি, গ্রাম বাংলা এনপিকে ফার্টিলাইজার অ্যান্ড অ্যাগ্রো লি. ৩ কোটি ৩০ লাখ, রয়েস অ্যাগ্রো ফার্মস লি. সাড়ে ৫ কোটি এবং ইনফরমেশন টেকনোলজি ম্যাট্রিক্স বাংলাদেশ লিমিটেড, ক্রিস্টাল ইনফরমেটিক্স লিমিটেড, আলফা সফট সিস্টেমস লিমিটেড ও ইলেকট্রনিক ডিজিটাল সিস্টেমস লিমিটেড পৌনে ২ কোটি টাকা।

এছাড়া তালিকায় আরও আছে-ফরচুন পোলট্রি হ্যাচারি আড়াই কোটি, ইফাডাফ ইকুয়া লি. সাড়ে ৩ কোটি, সীনহা গ্রীনারী অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স লি. ডিএনএ স্টার্টকম লি. ৩ কোটি টাকা, হবিগঞ্জ অ্যাগ্রো প্রসেসিং ৪ কোটি টাকা, সপ্তডিংগা পোলট্রি হ্যাচারি সোয়া ২ কোটি টাকা, স্টার মিল্ক প্রডাক্ট দেড় কোটি, প্রিমিয়াম সিড ১ কোটি, মামুননগর মাল্টিপারপাস অ্যান্ড অ্যাগ্রো ফার্ম ১ কোটি, অর্মি মর্ডান প্রণ হ্যাচারি ১ কোটি, ফেরদৌস বায়োটেক (প্রা.) ২ কোটি, নাজমুল ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ ২ কোটি, তানজিন অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স এক কোটি, মারফি ম্যাককান কনসালটিং ৮০ লাখ এবং ড্রিমস সফট লি. ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

সিএজি প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার আগে উদ্যোক্তার ৫১ শতাংশ টাকা আগেই বিনিয়োগ করতে হবে। বাকি ৪৯ শতাংশ অর্থ ইইএফ থেকে দেওয়ার কথা। এই টাকা ঋণ নেওয়ার ৮ বছরের মধ্যে ফেরত দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এসব টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেরত পায়নি। অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম ছাড়াই ঋণ দেওয়া হয়েছে, সঠিকভাবে মনিটরিং করা হয়নি। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইসিবির ইইএফ ইউনিটের কতিপয় কর্মকর্তা মিথ্যা, ভুল প্রতিবেদন দিয়ে ঋণ পেতে সহায়তা করেছে। ওইসব উদ্যোক্তা ঋণ নিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ঋণ ইস্যু, মনিটরিং এবং যার গাফিলতিতে এই অর্থ বেরিয়ে গেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম