ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেল রুট
জরাজীর্ণ লাইনে মরণফাঁদ, নতুন প্রকল্পে দৌড়ঝাঁপ
আয়ুষ্কাল শেষ হলেও পরিবর্তন করা হচ্ছে না * দুই যুগেও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই * বুলেট ট্রেনের গল্পে ভাটা, সমীক্ষার ১১০ কোটি টাকা জলে

শিপন হাবীব
প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
রেলওয়েতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সমানতালে চলছে। কিন্তু ট্রেনের গতি বাড়ছে না। রেললাইন জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় ট্রেন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। বিভিন্ন সেকশনে গতিও কমছে। অথচ বুলেট ট্রেনের নামে শত কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে লাইনের অবস্থা সবচেয়ে জরাজীর্ণ। এখানকার লাইনের (লোহা) আয়ুষ্কালের ৭৫ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে। জরাজীর্ণ লাইন সংস্কার না করে বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। সমীক্ষার নামে ১১০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এর পুরোটাই জলে গেছে। কারণ বুলেট ট্রেন ‘আপাতত’ হচ্ছে না। বুলেট ট্রেন সমীক্ষার নামে শত কোটি টাকা ব্যয় না করে জরাজীর্ণ লাইন সংস্কার করলে কিছুটা হলেও ট্রেনের গতি বাড়ত। ঘোষণার চার বছর পর ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ৫৫ মিনিটে বুলেট ট্রেন চালানোর সমীক্ষা করা হয়। গত বছর জুলাইয়ে সমীক্ষার পর সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয় বুলেট ট্রেন চালানোর প্রকল্প থেকে ‘আপাতত’ সরে এসেছে।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে বর্তমানে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন রেলইঞ্জিন ও যাত্রীবাহী কোচ রয়েছে। অথচ এ রুটে প্রতিটি ট্রেন গড়ে ৩৫ থেকে ৪৫ কিলোমিটার গতিতে চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১২০-১৩০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন ট্রেন চালাতে হলে জরাজীর্ণ রেললাইন উপযুক্ত করে তুলতে হবে। যাত্রীসেবার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কম সময়ে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া। অথচ ট্রেনের গতি নেই ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বলার মতো নয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চলমান ৩৯টি উন্নয়ন প্রকল্পে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। অথচ জরাজীর্ণ লাইন সংস্কারে আলাদা করে কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ৩২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে এখনো ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা (শুধু আন্তঃনগর ট্রেন) সময় লাগছে। লোকাল, মেল ও কমিউটার ট্রেনের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা সময় লাগছে। লাইন সংস্কার হলে মাত্র ৩ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছানো সম্ভব হতো। লাইন জরাজীর্ণ হওয়ায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন-কোচ সমন্বয়ে করে চলা ট্রেনগুলো গড়ে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার গতি নিয়ে চলছে। উচ্চমূল্যে কেনা ইঞ্জিন-কোচেও ট্রেন যাত্রীরা সুফল পাচ্ছেন না।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে প্রকৌশলী দপ্তর ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রেলপথে মোট দুর্ঘটনা ও লাইনচ্যুতির প্রায় ৭০ শতাংশই ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম লাইনে ঘটে। সিলেট রুটের কোনো কোনো সেকশনে ঘণ্টায় মাত্র ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলাচল করছে। একই অবস্থা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটেও। কয়েকটি সেকশনে গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার গতি নিয়ে দুটি আন্তঃনগর ট্রেন (সোনার বাংলা, সুর্বণ এক্সপ্রেস) চলাচল করছে। এ পথে লাইন সবচেয়ে বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। প্রায় দুই যুগ আগে অধিকাংশ লাইনের আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে। ২০১৫ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের চিনকি আস্তানা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত ক্ষয়প্রাপ্ত লাইন পরিবর্তন করা হয়। ওই সময় রেলওয়ের রেলপথ পরিদর্শকের (জিআইবিআর) জরুরি নির্দেশ ছিল- দ্রুততার সঙ্গে পর্যায়ক্রমে পুরো রুটের লাইন পরিবর্তনের। কিন্তু ২০১৫ সালের পর কোনো লাইনই পরিবর্তন করা হয়নি।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রকৌশলী দপ্তরের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, শুধু লাইন নয়, রেলওয়ে সেতুগুলোর অবস্থাও করুণ। মেয়াদোত্তীর্ণ অধিকাংশ সেতু জ্যাকেটিং সিস্টেমে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। এসব সেতুর ওপর দিয়ে কোনো ট্রেনই নির্ধারিত গতি নিয়ে চলতে পারে না। ক্ষয়প্রাপ্ত আর পাথরবিহীন লাইনে ট্রেনের গতি ওঠানো সম্ভব হয় না। ইচ্ছা থাকলেও কাঙ্ক্ষিত গতি নিয়ে চালক ও গার্ডরা ট্রেন চালাতে পারেন না। ১২০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন ইঞ্জিন নিয়ে অর্ধেক গতিতেও ট্রেন চালানোর ঝুঁকি নেন না চালক-গার্ডরা। তাদের বক্তব্য, গড়ে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চালালেই দুর্ঘটনা অথবা লাইনচ্যুতির আশঙ্কা থাকে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই চালক-গার্ডদের দায়ী করা হয়।
রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বুলেট ট্রেন চালানোর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সমীক্ষার অনুমোদন ২০১৭ সালে দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ে গত বছরের জুলাইয়ে ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা জমা দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ধরা হয়- এ প্রকল্পে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ হিসাব প্রাথমিক। রেলওয়ে ইতিহাসে বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ব্যয়ের চেয়ে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ ২-৩ গুণ বেড়ে যায়। তারা মনে করেন- এ মেগা প্রকল্পে হাত দেওয়ার আগে চলমান রেলপথের সংস্কার জরুরি। সিঙ্গেল লাইনগুলো ডাবল লাইনে রূপান্তরসহ রেলওয়ে সেতুগুলো নতুন তৈরি করা উচিত।
এদিকে রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বুলেট ট্রেন চালানোর সম্ভাব্যতা যাচাই চীনের একটি কোম্পানি করেছে। এর নেপথ্যে ছিলেন রেলওয়ের সাবেক দুই অতিরিক্ত মহাপরিচালক। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারা কর্মরত ছিলেন। অর্থ ছাড় থেকে শুরু করে রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চাপে রাখার কাজটিও তারা করেছেন।
রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, আমরা রেলের ব্যাপক উন্নয়ন করছি। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে রেলে আমূল পরিবর্তন আসবে। রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে গোটা রেলপথ সংস্কার করা হবে। সব মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ লাইনে রূপান্তর করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ডাবল লাইন। এছাড়া বুলেট ট্রেন চালাতে যে প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্ভাব্যতা যাচাই সমাপ্ত হয়েছে তা আমাদের নিশ্চয় কাজে আসছে। এটি আমরা বাতিল করিনি। আগামীতে বুলেট ট্রেনের মতো মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু করতে যেন সমস্যা না হয় সেজন্যই সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশার কাজ করে রাখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার রেলে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। অথচ আগের সরকারগুলো রেলকে ধ্বংস করে গেছে।
সাবেক এক রেলওয়ে মহাপরিচালক জানান, আর্থিকভাবে দুর্বল রেলের পক্ষে এখন বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন দেখা কঠিন। মাত্র ৩২০ কিলোমিটার রেলপথে বিশ্বের কোথাও বুলেট ট্রেন চালানো হয় না। এছাড়া বুলেট ট্রেনের মূল শর্তই হলো গতি। এজন্য প্রয়োজন ডেডিকেটেড এলিভেটেড করিডর। এজন্য যে পরিমাণ জমির প্রয়োজন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তিনি আরও বলেন, বুলেট ট্রেন চালাতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। এ অর্থ রেলের অন্য কোনো খাত পেলে সার্বিক অবকাঠামোগত উন্নতি করতে পারবে।
গণপরিবহণ বিশ্লেষক ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, রেললাইন ও সেতুগুলো জরাজীর্ণ এবং চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ রুটের কোথাও কোথাও মরণফাঁদের সৃষ্টি হয়েছে। রেললাইন ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার নামেমাত্র করা হয়। অথচ রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা নতুন নতুন বাহারি প্রকল্প গ্রহণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বুলেট ট্রেন চালানোর সমীক্ষায় ১১০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বুলেট ট্রেন তো ইলেক্ট্রিফিকেশনের দ্বিতীয় ধাপ। বাংলাদেশ তো প্রথম ধাপই শুরু করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, চীন ডেমু ট্রেন বাংলাদেশে চাপিয়ে দিয়েছে। সেই চীনা কোম্পানিই বুলেট ট্রেনের সমীক্ষা করেছে। একই চক্র এসব করে আর্থিক ফায়দা লুটছে। চীন-জাপানসহ যেসব দেশে বুলেট ট্রেন চলছে সেখানে হাজার হাজার কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। বাংলাদেশে মাত্র ৩০০-৪০০ কিলোমিটার রেলপথ। তিনি বলেন, এসব প্রকল্পের ধারণা ‘উপর’ থেকে আসে, কিন্তু মাঠ পর্যায় থেকে উপরে যায় না। এতে উপরের লোকজন লাভবান হয়। ডেমু ক্রয় কিংবা বুলেট ট্রেন সমীক্ষায় আর্থিক ক্ষতির পেছনে থাকা কর্মকর্তা কিংবা উপরের লোকজনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা এখনই উচিত। তিনি আরও বলেন, বর্তমান রেলপথ সংস্কার করা হলেই সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া সম্ভব।