মামলা নিষ্পত্তিতে দুদকের রেকর্ড
জালে নেই ‘রুই-কাতলা’ অধিকাংশ ‘চুনোপুঁটি’
ব্যক্তিপরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করার প্রবণতা কমিশনকে প্রতিহত করতে হবে -ড. ইফতেখারুজ্জামান
হাসিব বিন শহিদ
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনা মহামারির মধ্যেই বিদায়ি বছরে অভিযোগ ও মামলা নিষ্পত্তিতে রেকর্ডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে বরাবরের মতোই এ বছরও দুদকের জালে ধরা পড়েছে শুধু চুনোপুঁটি (ছোট দুর্নীতিবাজ)-এমন মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, রুই-কাতলা (বড় দুর্নীতিবাজ) ধরে দুদককে নজির সৃষ্টি করতে হবে। এদিকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের কাছাকাছি পৌঁছানো এবং লাগামহীন দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসার আপ্রাণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে কমিশন।
বিদায়ি বছর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় হার্ডলাইনে থাকা, অভিযোগ নিষ্পত্তিতে রেকর্ড, অনুসন্ধান-তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা রোধে তিনগুণ কমিশন সভার বিষয়টি সুনাম কুড়িয়েছে কমিশন। একই সঙ্গে এ সময়ে দক্ষতা উন্নয়নে ৮০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট শক্তিশালীকরণ, প্রধান কার্যালয়ের জন্য নিজস্ব ভবন ও পৃথক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপনের সিদ্ধান্ত, নতুন জেলা কার্যালয় চালু, প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ এবং বিভিন্ন সংস্থাকে দুদকের দেওয়া সুপারিশের ফলোআপ শুরু এবং কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের সম্পদের অনুসন্ধান কার্যক্রম ছিল বেশ আলোচিত। অপরদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও তদন্ত নিয়ে হাইকোর্টের অসন্তোষ প্রকাশ, অর্থ পাচারকারীদের দায়সারা প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল, করোনায় স্বাস্থ্য খাতের রুই-কাতলা দুদকের জালে ধরতে না পারা এবং বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অনুসন্ধান ও তদন্তে ধীরগতি কমিশনের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, গত দুই বছর করোনার কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে আমরা চেষ্টা করেছি। জনগণের প্রত্যাশার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতিকে একটি কাঙ্ক্ষিত ও সহনীয় মাত্রায় আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই কমবেশি দুর্নীতি রয়েছে। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, আগের তুলনায় কমিশনের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বেড়েছে। বর্তমানে কমিশন তদন্ত ও অনুসন্ধানে দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আনা চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করেছে। এছাড়া আমাদের ব্যাপারে (দুদক কর্মকর্তা) কেউ যেন হয়রানির অভিযোগ করতে না পারে, সে বিষয়ে কড়া নজর রাখা হচ্ছে। দুদকের ওপর জনগণের আস্থা বাড়াতে সততা, নিষ্ঠা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, কমিশন সভা করা হলে সবাই মতপ্রকাশের সুযোগ পান। আমরা সভা করে প্রতিটি বিষয় আলোচনা করে দুর্বল দিকগুলো বের করে সংশোধনের চেষ্টা করি। সংগত কারণেই বেশি বেশি সভার প্রয়োজন পড়েছে। একটি সুন্দর ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনার উদ্দেশ্যেই কমিশন সভা করে থাকে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, গেল বছর করোনাসহ নানা কারণে প্রতিকূলতা ছিল। এতে যতটুকু সফলতা অর্জনের সুযোগ ছিল হয়তো ততটুকু করা সম্ভব হয়নি। তা সত্ত্বেও ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, গেল বছর কমিশন বেশকিছু ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কমিশনের কিছু কিছু কাজে মানুষের প্রত্যাশাও কমিশনের ওপর বেড়েছে। করোনার সময় স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির বিষয়গুলো খুব আলোচিত ছিল। সেক্ষেত্রে কিছু চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি করা হলেও পেছনের রুই-কাতলা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছে। এজন্য একটি মিশ্র চিত্র রয়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কমিশনকে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি রোধে দুদকের আইনি কাঠামোও রয়েছে। রাজনীতিক অঙ্গীকার থাকায় ব্যক্তিপরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করার প্রবণতা কমিশনকে প্রতিহত করা উচিত।
এক-চতুর্থাংশ অনুসন্ধান-তদন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ : দুদকের এক-চতুর্থাংশ অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমই মেয়াদোত্তীর্ণ। বিদ্যমান আইনের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ অনুসন্ধান এবং ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ মোট অনুসন্ধান ও মামলার তদন্তের হার ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। গত বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দুদকের মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ১১১৯টি এবং মেয়াদোত্তীর্ণ তদন্ত ২০৩টি।
স্বাস্থ্য খাতের বড় দুর্নীতিবাজ অধরা : করোনা মহামারির সময় স্বাস্থ্য খাতে নানা ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য প্রকাশ পায়। সেসব দুর্নীতির অনুসন্ধানে চুনোপুঁটি ধরা পড়লেও রুই-কাতলা ধরা পড়েনি বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
বড় অঙ্কের আত্মসাতের অনুসন্ধান ধীরগতি : বিদায়ি বছর বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনের ঋণ জালিয়াতিসহ বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতির অনুসন্ধান ও তদন্তে কচ্ছপগতি লক্ষ করা গেছে।
রাষ্ট্রপতির নির্দেশনার বাস্তবায়ন : গত ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসে ভিডিও বার্তায় রাষ্ট্রপতি ‘নিজ ঘর থেকে অভিযান শুরু’সহ নানা বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেন। এ নির্দেশনার পরপরই দুদক তার নিজস্ব কর্মকর্তাদের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে। এর মধ্যে সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারাও রয়েছেন।
বিগত সুপারিশের ফলোআপ : দুর্নীতি দমন ও নিয়ন্ত্রণে দুদক মামলা ও তদন্ত করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে থাকে। এ পর্যন্ত করা সুপারিশগুলোর কোনো ফলোআপ করা হয়নি। গেল বছরের শেষ নাগাদ এই ফলোআপ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। গত ২৯ ডিসেম্বর ১৮৪টি অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে (মাউশি) আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে দুদক। গত প্রায় ৩ বছরে (২০১৯ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর) দুদক ১৮৪টি অভিযোগ মাউশিতে পাঠায়। এর মধ্যে ৪২টি অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে ও ১৪২টি অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়। এছাড়া কমিশনের যাচাই-বাছাই কমিটি ২ হাজার ৮৮৯টি অভিযোগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে পাঠিয়েছে।
অনুসন্ধান ও তদন্ত নিষ্পত্তিতে রেকর্ড : বিগত বছরগুলোর তুলনায় কমিশনের গেল বছর অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষে নিষ্পত্তির হার রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। গেল বছর নতুন ৪৬৯টি অনুসন্ধানসহ ৪ হাজার ৩৬৭টি অনুসন্ধানের মধ্যে ৯৬১টি নিষ্পত্তি হয়েছে। এ সময় ৩২৭টি মামলা করা হয়েছে। অর্থাৎ ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ অভিযোগের অনুসন্ধান শেষে মামলা হয়েছে। ২০২০ সালের এ হার ছিল ৩১ দশমিক ৬৪ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৩২ দশমিক ১০ শতাংশ ও ২০১৮ সালে তা ছিল ২৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।
দ্বিগুণ কমিশন সভা : বিগত বছরগুলো প্রতিবছর প্রায় ১০ থেকে ১২টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বর্তমান কমিশনের ১০ মাসেই প্রায় ২৫টি সভা করেছে। সভার সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি করায় কমিশনের কাজের গতিও দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি : ২০১৮ সাল থেকে কমিশনের সাংগঠনিক কাঠামোতে যুক্ত হয়ে কাজ করছে কমিশনের গোয়েন্দা ইউনিট। কমিশনের একজন পরিচালকের নেতৃত্বে দেশজুড়ে কমিশনের গোয়েন্দারা ছড়িয়ে রয়েছে। এই ইউনিটের সার্বিক কাজ সরাসরি তদারকি করেন দুদক চেয়ারম্যান। এই ইউনিটে ৬৬৫টি অভিযোগ গোপন অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়। এর মধ্যে ২৫০টি নিষ্পত্তি হয়েছে। ৪১৫টি অভিযোগের গোপন অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। ১৫৪টি অভিযোগ প্রকাশ্য অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হয়েছে। এছাড়া এই ইউনিটের তথ্য নিয়ে পুলিশ ১৩ জন প্রতারককে গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের অভিযান : কমিশনের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট ২০১৯ সাল থেকে সাংগঠনিক কাঠামোতে যুক্ত হয়ে কাজ করছে। কোভিড পরিস্থিতির কাছে গেল বছর অভিযান পরিচালনার গতি কিছুটা কমেছে। এ সময় ২৩১টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ২০২০ সালে ৪৮৭টি ও ২০১৯ সালে ১ হাজার ১টি অভিযান পরিচালনা করা হয়।