টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন
তথ্য প্রকাশে এনজিওর অবস্থান উদ্বেগজনক
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব ওয়েবসাইটে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তথ্য প্রকাশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সন্তোষজনক অবস্থানে থাকলেও প্রায় ৯৫ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (নন-গভনর্মেন্টাল অর্গানাইজেশন-এনজিও) অবস্থান উদ্বেগজনক।
এছাড়া আইনি বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশে এনজিওগুলো গোপনীয়তার আশ্রয় নেয়। বৃহস্পতিবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ চর্চার মূল্যায়ন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সমন্বয়ক তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম। ১৫৩টি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ৩৯টি এনজিওর ওপর গবেষণা করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের কোনো ওয়েবসাইট নেই।
গবেষণা প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের যেমন কৃতিত্ব রয়েছে-তেমনি বেসরকারি সংস্থাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। আইনটি বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব রয়েছে বলে দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মোটাদাগে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের অবস্থা সন্তোষজনক। ১০ বছরে অনেকটা সম্প্রসারিত হয়েছে। তিনি বলেন, সব ধরনের মাপকাঠি অনুযায়ী তুলনামূলক সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে তাদের আরও অগ্রগতি ও উন্নতির সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে এনজিওগুলো সন্তোষজনক অবস্থানে নেই। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক। শুধু তাই নয়, প্রায় ৯৫ শতাংশ এনজিওর অবস্থান উদ্বেগজনক।
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাপ্ত গ্রেডিংয়ের বিন্যাস অনুযায়ী- সরকারি উদ্বেজনক প্রতিষ্ঠান ১৪ শতাংশ, বেসরকারি উদ্বেজনক ৩৬ শতাংশ। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য প্রকাশে অপর্যাপ্ত রয়েছে ৮২ শতাংশ, আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ৩ শতাংশ। সন্তোষজক গ্রেডিংয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান ৫৭ শতাংশ। এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থান একেবারে শূন্যের কোটায়।
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে স্কোরিং করা হয়। নির্ধারিত তিনটি ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত ২৫টি নির্দেশককে (তথ্যের ব্যাপ্তিতে ১৯টি, প্রবেশগম্যতায় চারটি ও উপযোগিতায় দুটি নির্দেশক) তথ্য প্রকাশের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। প্রতিটি নির্দেশকের জন্য পূর্ব নির্ধারিত শর্ত বা কোড অনুযায়ী (উচ্চ=২; মধ্যম=১; নিু= শূন্য স্কেল) স্কোর দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্কোর পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের প্রযোজ্য সব নির্দেশকের স্কোর যোগ করা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের সার্বিক স্কোর পাওয়ার জন্য যোগ করা হয়েছে সব নির্দেশকের স্কোর।
প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ স্কোরের (২৫টি নির্দেশককে সর্বোচ্চ স্কোর ৫০) সাপেক্ষে প্রাপ্ত স্কোরের শতকরা হার বের করা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো নির্দেশক প্রযোজ্য না হলে সেই নির্দেশকে কোনো স্কোর দেওয়া হয়নি এবং তা মোট স্কোর ও শতকরা হার থেকে বাদ রাখা হয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে সব নির্দেশকের বিবেচনায় সার্বিক স্কোর নিরূপণ করা হয়েছে। এভাবে প্রাপ্ত চূড়ান্ত স্কোরের শতকরা হারের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানের গ্রেডিং (সন্তোষজনক, অপর্যাপ্ত, উদ্বেগজনক)।
টিআইবির দেওয়া প্রাপ্ত স্কোর (৩২-৪২) এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রথম ১০টি র্যাংকিং অবস্থানে ৬৯টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ৪২ স্কোর (৮২ শতাংশ) পেয়ে প্রথম স্থানে রয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বনিু (৪ স্কোর তথা ৮ শতাংশ) অবস্থানে রয়েছে আন্তঃবাহিনী নির্বাচন পর্ষদ। এছাড়া এনজিওদের মধ্যে প্রথম ১০টি অবস্থানে রয়েছে ১৯টি প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রাপ্ত স্কোর ৭ থেকে ২২-এর মধ্যে। সর্বোচ্চ স্কোর ২২ তথা ৪৪ শতাংশ পেয়েছে কোস্টাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল ট্রান্সফরমেশন।
প্রাতিষ্ঠানিক শতকরা হারে টিআইবি যে মূল্যায়ন করেছে সে নিয়ম অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠান তথ্য প্রদানে উদ্বেগজনক (০% থেকে ৩৩%), অপর্যাপ্ত (৩৪% থেকে ৬৬%), সন্তোষজনক হারে (৬৭% থেকে ১০০%)। সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সন্তোষজনক, অপর্যাপ্ত উদ্বেগজনক যথাক্রমে ৭৫.৫%, ২৪.৫, শূন্য শতাংশ। একইভাবে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ১৭.৪%, ৭৬.১%, ৬.৫%। সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সংস্থা, ট্রাস্ট, ফাউন্ডেশন, পাবলিক কোম্পানি ৩.২%, ৭৪.২%, ২২.৬ শতাংশ। তবে খুবই খারাপ অবস্থানে এনজিওগুলো তারা সন্তোষজনক অবস্থানে শূন্য শতাংশ, অপর্যাপ্ত ৫.১%, উদ্বেগজনক ৯৪.৯ শতাংশ। টিআইবির গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, ওয়েবসাইটে আপলোড করা তথ্য হালনাগাদ করার সময়সীমার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো সময়ের উল্লেখ নেই। এছাড়া খুব কম সংখ্যক সরকারি প্রতিষ্ঠানের (০.৭ শতাংশ) ওয়েবসাইট প্রতিবন্ধীদের সেবা সংশ্লিষ্ট কিছু তথ্য থাকলেও অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিও ওয়েবসাইট ভয়েস অ্যাক্টিভেটেড বা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়।
সহজে তথ্য পেতে ১১টি সুপারিশ করেছে টিআইবি। নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রকাশ ও প্রচার নির্দেশিকা প্রণয়ন এবং ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করতে হবে। নির্দেশিকার কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে তদারকি বাড়াতে হবে। বিধি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, সেবা ও সেবা প্রদানকারীর তথ্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষমতা ও দায়িত্ব, সভার সিদ্ধান্ত, বার্ষিক বাজেট, নিরীক্ষা প্রতিবেদন, তথ্যপ্রাপ্তির আবেদনের মাধ্যমে কতজন, কী ধরনের তথ্য চেয়েছে তার হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণ এবং প্রদান করা। এছাড়া তথ্য অধিকার আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত আবেদনের তথ্যের ধরন বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তথ্যের ঘাটতি চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ ও তা ওয়েবসাইটে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত তথ্য ও কার্যক্রম সম্পর্কিত অভিযোগ দায়েরের জন্য ওয়েবপেজে সুনির্দিষ্ট স্থান রাখতে হবে এবং অনলাইনের মাধ্যমে কার্যকর নিষ্পত্তি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় ও নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রচলিত ফন্টে (ইউনিকোড) প্রকাশ করতে হবে। ওয়েবসাইট ব্যবস্থাপনা বিভাগের জনবলের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। এনজিও পর্যায়ে ওয়েবসাইটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীসহ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচার সম্পর্কে জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে এবং হালনাগাদকরণের তারিখ উল্লেখ করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের সংশ্লিষ্ট সেবা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করতে হবে; ওয়েবসাইটকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করার উদ্দেশ্যে ভয়েস অ্যাক্টিভেটেড ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।