Logo
Logo
×

শেষ পাতা

সর্বত্র গাফিলতির চিহ্ন

ঝুঁকি নিয়ে চলছে রেল

লাইনে ২২ লাখ ঘনফুট পাথর থাকার কথা, আছে ১০ লাখ ঘনফুট * মাসে ৯০-১২০টির মতো ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে, বছরে ক্লিপ চুরি ৫ লাখ পিস

Icon

শিপন হাবিব

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০১৮, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঝুঁকি নিয়ে চলছে রেল

বাংলাদেশে ঝুঁকি নিয়ে চলছে রেল। ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়াসহ ছোটখাটো দুর্ঘটনা লেগেই আছে। যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনায় বিপুল প্রাণহানি ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সর্বত্রই দায়িত্বে অবহেলার চিহ্ন।

কিছু দিন আগে স্টেশন মাস্টারের গাফিলতির কারণে টঙ্গীতে একটি ‘কমিউটার ট্রেন’ লাইনচ্যুত হলে ৪টি তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে। এরপর রেল কর্তৃপক্ষ কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও তিন হাজার কিলোমিটার রেল লাইনের দিকে তাকালেই দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠছে। কেন্দ্রে রেল নিয়ে তোড়জোড় চললেও মাঠপর্যায়ে বেহাল দশা। রেল লাইনে পাথর থাকা অপরিহার্য হলেও মাইলের পর মাইল রেল লাইনে পাথর নেই, চুরি হয়ে যাচ্ছে।

সারা দেশে ২২ লাখ ঘনফুট পাথর থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ৮ থেকে ১০ লাখ ঘনফুট। লাইনের ইলাস্টিক রেল ক্লিপ (প্যান্ডেল), নাট-বল্টু চুরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। রেলের একটি সূত্র বলছে, প্রতি বছর ক্লিপ-ই চুরি যাচ্ছে ৫ লাখ পিস, টাকার অংকে এর পরিমাণ ১০ কোটি টাকা। কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত রেল লাইনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে (জোড়া) হুক খোলা দেখতে পাওয়া যায়। সূত্র বলছে, যথাযথ মেইনটেন্যান্স না করার কারণে প্রতি মাসে ৯০-১২০টির মতো ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে।

রেলপথ প্রকৌশল বিভাগ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ৭৫ শতাংশ ট্রেন লাইনচ্যুত হয় যথাযথভাবে লাইন মেইনটেন্যান্স না করার কারণে। অথচ লাইনে পথর দেয়ার জন্য বছরে ৩৩ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে রেলের। লাইনচ্যুত বগি ও ইঞ্জিন উদ্ধার এবং লাইন মেরামতে বছরে ব্যয় হচ্ছে ৯৬ কোটি টাকা।

রেলের এ দুর্দশা নিয়ে জানতে চাইলে রেল বিভাগের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, রেল হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ বাহন। সরকার রেলের উন্নয়নে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তা সম্পূর্ণ হলে বদলে যাবে রেল। কিন্তু মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।

তিনি বলেন, ‘লাইনে প্রয়োজনীয় পাথর থাকবে না, ক্লিপ, নাট-বল্টু খোলা থাকবে এটা কি করে সম্ভব। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা শুরু হয়েছে, দায়িত্বে অবহেলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ সম্প্রতি মগবাজার রেলগেট থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত লাইন ঘুরে দেখেন এ প্রতিবেদক। অনেক জায়গায় পাথরের বদলে কাদাপানি জমে থাকতে দেখা গেছে। লাইনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পয়েন্টে (জোড়া) হুক খোলা দেখতে পাওয়া যায়।

রেলের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বছরে কমপক্ষে ৫ লাখের বেশি ক্লিপ চুরি বা ভেঙে গেলেও এর মধ্যে ২ থেকে সোয়া দুই লাখ ক্লিপ সরবরাহ করা হয়। সাপ্লাই দেয়া এসব ক্লিপের সব লাগানোও হয় না। ফলে বছরের পর বছর ক্লিপবিহীন লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল করে। এসব ক্লিপে ‘বিআর’ (বাংলাদেশ রেলওয়ে) লেখা থাকলে চুরি রোধ করা অনেকাংশে সহজ হতো। একটি ক্লিপ বাইরে ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

ক্লিপ চুরির কথা স্বীকার করে ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি মো. ইয়াছিন ফারুক বলেন, বর্তমানে চুরির ঘটনা কমে এসেছে। তবে লাইনে পাথর আছে কিনা কিংবা যন্ত্রাংশ খোলা রয়েছে কিনা তা রেল পুলিশের দেখার কথা নয়। লাইন পাহারায় পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ ও আধুনিক ক্লিপ লাগানো নিশ্চিত করা গেলে এসব চুরি রোধ সম্ভব।

পূর্বাঞ্চল রেলপথের প্রধান ট্র্যাক সাপ্লাই অফিসার তরুণ কান্তি বালা যুগান্তরকে জানান, মন্ত্রণালয়ের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে, যেখানেই লাইনের ক্লিপ খোয়া যাবে, দ্রুত তা লাগাতে হবে। গত বছর ১ লাখ ৬৫ হাজার নতুন ক্লিপ লাগানো হয়েছে।

তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা না এলে চুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। রাতের আঁধারে এসব যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে। তিনি বলেন, বছরে প্রায় ৫-৬ লাখ হুক চুরি হচ্ছে। লাইনে বছরে ৫ শতাংশ হারে নতুন করে পাথর দেয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না।

পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথের প্রধান ট্র্যাক সাপ্লাই অফিসার প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান জানান, চাহিদা অনুযায়ী মালামাল সাপ্লাই দেয়া হলেও মাঠপর্যায়ে অবহেলা রয়েছে। তিনি বলেন, ক্লিপ ও হুক শুধু চুরিই হয় না, ভেঙেও যায়। টেন্ডার শেষে এসব মালামাল পেতে ৬-৭ মাস লেগে যায়।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পথ) আবু জাফর মিয়া জানান, একজন কি-ম্যানের ৫-৬ কিলোমিটার রেলপথ প্রতিদিন হেঁটে পরিদর্শন করার কথা। প্রতি ইঞ্চি লাইন তার নিজ চোখে দেখে ত্র“টি ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে মিস্ত্রি (মেট) ডেকে মেরামত করার কথা।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পথ) মো. তানভীর জানান, মাঠপর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাজ করার কথা থাকলেও তা ঠিকভাবে হচ্ছে না। তবে তিনি লোকবল স্বল্পতার কথাও জানান।

রেল পরিদর্শক (জিআইবিআর) আক্তারুজ্জামান জানান, মাঠপর্যায়ে রেলপথের অবস্থা খুবই করুণ। আমরা যতবারই লাইন পরিদর্শন করেছি, ততবারই সমস্যার কথা বলেছি। কিন্তু সমস্যা সমাধান করবে তো সংশ্লিষ্টরা। অনেক স্টেশন বন্ধ। ওই সব স্টেশনের আশপাশ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম