Logo
Logo
×

শেষ পাতা

অনুসন্ধান চালাচ্ছে র‌্যাব-পুলিশ

সাপের বিষ মাদকে!

বিভিন্ন মাদকে খুব সামান্য ব্যবহার হচ্ছে : আশিক বিল্লাহ * সাময়িক স্নায়বিক বিভ্রমের জন্য মাদকে মেশানো হয় বিষ : ইবরাহীম আল হায়দার

Icon

মাহমুদুল হাসান নয়ন

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২১, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাপের বিষ মাদকে!

মাঝেমধ্যেই সাপের বিষ উদ্ধারের তথ্য দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে পরীক্ষায় দেখা গেছে, এগুলোর অধিকাংশই ভেজাল। তবে কখনও কখনও ধরা পড়ছে খাঁটি বিষের চালানও। তাই প্রশ্ন উঠেছে-এ বিষ কী কাজে ব্যবহার হয়?

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশ্লেষকরা এটি মাদকে ব্যবহারের শঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না। কারণ, কয়েকটি দেশে এর নজির রয়েছে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও জব্দ করা বিভিন্ন মাদক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, বেশ কিছু জায়গায় আমরা দেখতে পেয়েছি সাপের বিষকে মূলত মাদক হিসাবে গ্রহণ করা হচ্ছে।

যদিও এটা খুবই সামান্য পরিমাণে। সাপের বিষের একটা মডিফাইড বা মিশ্রণ নিয়ে মাদক তৈরি হয় বলে আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাপের বিষ সরাসরি মাদক হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ নেই। তবে সাপ থেকে দেশীয়ভাবে বিষ সংগ্রহের কিছু ঘটনা বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে।

নিয়ম হলো এ বিষ মিল্কিং (সংগ্রহ পদ্ধতি) করার পর ‘ফ্রিজ ড্রাই’ (পাস্তুরিত তরল দুধ যেভাবে পাউডার করে) করতে হবে। কিন্তু যেসব প্রকৃত বিষ উদ্ধারের খবর পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো তা করা হয় না।

সাধারণত সাপের বিষ খোলা রেখে দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুকিয়ে যায়। এ প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে তরল বিষ শুকিয়ে দানা বাঁধলে তা গুঁড়া করা হয়।

এরপর তা মেশানো হয় মদসহ বিভিন্ন মাদকে। সাধারণত ১০০ লিটার মদে ১০ গ্রাম সাপের বিষের গুঁড়া মেশানো হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ‘ভেনম রিসার্চ সেন্টার’র সহকারী গবেষক ইবরাহীম আল হায়দার যুগান্তরকে বলেন, একেক সাপের বিষ একেক রকম। কিছু বিষ হিমোটক্সিক, রক্তে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

কিছু বিষ মায়োটক্সিক, পেশির ক্ষতি করে। আর কিছু বিষ নিউরোটক্সিক, যা স্নায়ুতন্ত্রে বা মস্তিষ্ক আক্রান্ত করে। যে বিষগুলো নিউরোটক্সিক সেগুলোই মূলত মাদকে ব্যবহার হয়।

এর মাধ্যমে কিছু সময়ের জন্য ‘নিউরাল ডিজঅর্ডার’ (স্নায়ুবিক বিভ্রম) হয়। এগুলোই সরাসরি শরীরে না নিয়ে মাদকের সঙ্গে মিশিয়ে নেশার জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে মাদক হিসাবে সাপের বিষের ব্যবহারের আলোচনা নতুন। বছর তিনেক আগে ভারতের বিহারের পুর্নিয়ায় সাপের বিষের একটি চালান আটকের পর এটি আলোচনায় আসে।

ভারতের বন্যজীবন অপরাধ দমন ব্যুরো ও গুজরাটের বন বিভাগ চালানটি আটক করে। এরপর সেখানকার গণমাধ্যমে সাপের বিষ মাদকে ব্যবহারের খবর বের হতে থাকে।

বাংলাদেশ থেকে চোরাই পথে ওই বিষের চালানটি বিহারে ঢুকেছিল বলেও অভিযোগ করে তারা। এ ঘটনার পর এ বিষয়ে দেশীয় সাপ গবেষকরাও কাজ শুরু করেন।

সাপ ও সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. আবু রেজা।

তিনি যুগান্তরকে বলেন, কিছু কিছু মাদকে অল্প পরিমাণে সাপের বিষের ব্যবহার হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।

তিনি আরও বলেন, সাপের বিষ নেশা হিসাবে সরাসরি শরীরে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা খুবই মারাত্মক। কারণ এ ডোজটা এতটাই প্রিসাইজড যে, কতটুকু নিতে হবে এর হিসাব বের করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

এজন্য মাদকে ব্যবহারের যে বিষয়টি উঠে আসছে সেটি কীভাবে হয় তা নিয়ে কাজ করতে হবে।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের সহকারী রাসায়নিক পরীক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম সরকার যুগান্তরকে বলেন, মাদক বলতে যা আমরা বোঝাই তা মূলত তিন ধরনের।

একটা হচ্ছে উত্তেজক, আরেকটা নিস্তেজক এবং অন্যটি হ্যালোসিনেবল বা মতিবিভ্রমকারক। এর বাইরে আরেকটি রয়েছে এনালজেসিক।

মানে পেইন কিলার বা বেদনানাশক। যেটা সাময়িকভাবে ব্যথা থেকে মুক্তি দেবে। সাপের কিছু বিষ এনালজেসিক তৈরিতে কাজে লাগে।

মাদকে সাপের বিষের ব্যবহারের সূচনা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৮ শতকে চীনে আফিম ব্যবহার হতো ছোটখাটো রোগের চিকিৎসায় ওষুধ হিসাবে।

এগুলো আসত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে। দীর্ঘ সময় পর চীনের মানুষ আফিমকে মাদক হিসাবে ব্যবহার শুরু করেন। একপর্যায়ে অবস্থা এমন হয় যে, আফিম সেবনে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন অনেক রাজকর্মচারীও।

চূড়ান্ত অবস্থায় যখন আফিমে আর নেশা হয় না, তখন তারা এতে ভিন্নতা আনার চেষ্টা করেন। সে সময়ে আফিমে সাপের বিষের ব্যবহারের কথা জানা যায়।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, তখন আফিমের নেশা এতটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছায় যে তৎকালীন প্রতাপশালী রাজা চিয়াচিং চীনে আফিমের ঢোকা বন্ধ করে দেন।

এ নিয়ে চীন ও ব্রিটেনের মধ্যে ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত আফিম যুদ্ধ বা ওপিয়াম ওয়ারও হয়। সেখানে আফিমের ব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে আফিমে আর নেশা হতো না।

নার্ভগুলো এমন অবস্থায় চলে গিয়েছিল যে আরও কড়া নেশা দরকার। তখন তারা সাপের বিষের নেশা করত। সেটা হতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মারা যাওয়ার আগে।

এ অধ্যাপকের শঙ্কা, সাপের বিষের আড়ালে মাদক ব্যবসাও চলছে। তিনি বলেন, যাদের সাপের বিষ নিয়ে ধরা হচ্ছে এরা মূলত মাদক ব্যবসায়ী।

পুলিশ ও র‌্যাবকে এর শেকড় খুঁজে বের করতে হবে, চক্রটাকে আবিষ্কার করতে হবে। এদের ধরে শক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম