ঢাকার যানজট নিরসন
৪৬ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে শঙ্কা
নির্মিত হবে দুটি পাতাল রেল, ৩টি এলিভেটেড রেল, হাতে নেয়া হয়েছে বৃত্তাকার জলপথ উন্নয়ন প্রকল্প
মতিন আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০১৮, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকাকে বলা হয় যানজটের নগরী। নিত্যদিনের এ দুর্ভোগ থেকে নগরবাসীকে উদ্ধারে বৃহত্তর ঢাকাকে ঘিরে নেয়া হয়েছে এক মহাপরিকল্পনা। এ মহাপরিকল্পনার আওতায় নেয়া ৪৬টি মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখে এ নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (আরএসটিপি) আলোকে নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়নের
সুপারিশ থাকলেও নানা কারণে এর গতি থমকে
আছে। এসব মেগা প্রকল্পের মধ্যে ম্যাস রেপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ বা মেট্রোরেল বাস্তবায়নের কাজ
শুরু হলেও এর যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারছে না বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। দক্ষ জনবলের অভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিক অক্ষমতার কারণে এ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বাকি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা দুরূহ বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
বৃহত্তর ঢাকার (ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী) ৭ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে সৃষ্ট যানজট নিরসনে ৫টি ম্যাস রেপিড ট্রানজিট (এমআরটি), ২টি বাস রেপিড ট্রানজিট (বিআরটি), ৩টি রিং রোড, ৮টি রেডিয়াল সড়ক, ৬টি এক্সপ্রেসওয়ে, ২১টি ট্রান্সপোর্টেশন হাব এবং ঢাকার চারপাশের জলপথ উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে প্রণীত এ সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করা গেলে যানজট থাকবে না। ২০২৫ সালের মধ্যে এসব প্রকল্পের বড় অংশ বাস্তবায়ন করা না গেলে যানবাহনের গতি কমে মানুষের গতির নিচে নেমে যাবে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ঢাকায় ঘণ্টায় পরিবহনের গতিবেগ প্রায় সাত কিলোমিটার। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সালে পরিবহনের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের গতির চেয়ে কম। ঘণ্টায় মানুষের গতিবেগ ৫ কিলোমিটার। যানজটের কারণে ঢাকায় দিনে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা ও এর আশপাশে যানজট নিরসনে আরএসটিপিতে সুন্দর দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আরএসটিপির আদলে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করলে ঢাকা এবং এর আশপাশে যানজট অনেকটা নিরসন সম্ভব। আরএসটিপির সুপারিশকৃত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে ডিটিসিএ’র সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স বাংলাদেশের (বিআইপি) সভাপতি একেএম আবুল কালাম যুগান্তরকে বলেন, ‘বৃহত্তর ঢাকার যানজট নিরসনে ডিটিসিএ চমৎকার মাস্টারপ্ল্যান করেছে। চমৎকার প্রকল্পের ধারণা দেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে যানজট প্রকট আকার ধারণ করবে।’
এ প্রসঙ্গে ডিটিসিএ’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আহম্মদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আরএসটিপি যানজট নিরসনের একটি চমৎকার মহাপরিকল্পনা। এখানে প্রায় অর্ধশত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশ রয়েছে। যথাসময়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে ভবিষ্যতে বৃহত্তর ঢাকার যানজট নিরসনে যেসব অশনিসংকেত দেখা যাচ্ছে, তা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। সরকার এর গুরুত্ব অনুধাবন করে ডিটিসিএ’র সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।’
যানজট নিরসনে মেগা প্রকল্প এমআরটি লাইন-১ : এ মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ২৭ কিলোমিটার। এটি হবে দেশের প্রথম পাতাল রেল। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত প্রায় ১৭ কিলোমিটার পথ যাবে মাটির নিচ দিয়ে। আর বসুন্ধরা থেকে পূর্বাচল টার্মিনাল পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এলিভেটেড মেট্রোরেল হবে। ২০১৭ সালের ২৯ জুন জাইকার সহযোগিতায় ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বর্তমানে এর সম্ভাব্যতা যাচাই হচ্ছে। এর নির্ধারিত রুট হচ্ছে- হয়রত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে খিলক্ষেত-কুড়িল-যমুনা ফিউচার পার্ক এবং বাড্ডা-রামপুরা-মালিবাগ-রাজারবাগ-কমলাপুর। প্রস্তাবিত মেট্রোরেলের স্টেশনগুলো হচ্ছে- বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, কুড়িল, যমুনা ফিউাচার পার্ক, নতুনবাজার, বাড্ডা, হাতিরঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ, কমলাপুর। অন্যদিকে কুড়িল থেকে কাঞ্চন সেতুর পশ্চিম দিক পর্যন্ত কুড়িল, বসুন্ধরা, মাস্তল, পূর্বাচল পশ্চিম, পূর্বাচল সেন্টার, পূর্বাচল টার্মিনাল।
এমআরটি-২ : আশুলিয়া থেকে শুরু হয়ে নবীনগর সাভার হয়ে গাবতলী-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-ডিএসসিসি-কমলাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এ মেট্রোরেল। এর প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
এমআরটি-৪ : কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এটা পাতাল রেল হওয়ার কথা। এটি রেল বিভাগের করার কথা।
এমআরটি-৫ : হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত এ মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ২০ কিলোমিটার। নির্ধারিত রুট : হেমায়েতপুর-গাবতলী-টেকনিক্যাল-মিরপুর-১-মিরপুর-১০-মিরপুর-১৪-কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান-২-নতুনবাজার ও ভাটারা। এর মধ্যে হেমায়েতপুর-আমিনবাজার পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার এবং নতুনবাজার থেকে ভাটারা পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার পর্যন্ত দুই অংশে ১২ কিলোমিটার মাটির উপর দিয়ে নির্মিত হবে। আর বাকি আট কিলোমিটার আমিনবাজার থেকে তুরাগ নদের তলদেশ দিয়ে নতুনবাজার পর্যন্ত যাবে। এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। আর এমআরটি লাইন-৫ এর অপরাংশের রুট হচ্ছে- গাবতলী থেকে ধানমণ্ডি হয়ে পান্থপথ-হাতিরঝিল লিংক রোড পর্যন্ত যাবে। প্রস্তাবিত স্টেশনগুলোর মধ্যে রয়েছে- হেমায়েতপুর, বালিয়ারপুর, মধুমতি, আমিনবাজার, গাবতলী, দারুসসালাম, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, মিরপুর-১৪, কচুক্ষেত, বনানী, গুলশান-২, নতুনবাজার, ভাটারা।
এমআরটি লাইন-৬ : উত্তরা আবাসিক এলাকার তৃতীয় প্রকল্প থেকে শুরু হয়ে মতিঝিলে গিয়ে শেষ হবে। এ মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। এটি দেশের প্রথম মেট্রোরেল। প্রথমে প্রকল্পটির মেয়াদকাল ২০১২-২০২৪। পরবর্তী সময়ে বিশেষ উদ্যোগে উত্তরা-আগারগাঁও পর্যন্ত অংশ ২০১৯ সাল এবং বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত অংশ ২০২০ সালের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। এমআরটি লাইন-৬ মোট ৮টি প্যাকেজে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ মেট্রোরেলের মোট ১৬টি স্টেশন থাকবে। স্টেশনগুলো হল- উত্তরা, উত্তর-উত্তরা, সেন্টার-উত্তরা, দক্ষিণ পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, মতিঝিল।
বিআরটি-৩ : গাজীপুরে শুরু হয়ে শেষ হবে ঝিলমিল আবাসন প্রকল্পের কাছে। এটি ২টি ভাগে বাস্তবায়িত হবে। প্রথম ভাগে হবে প্রায় ২১ কিলোমিটার। এ অংশে মোট ২৫টি স্টেশন থাকবে এবং ঘণ্টায় ২৫ হাজার যাত্রী বহন করা যাবে। আর দ্বিতীয় ভাগে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে প্রায় ২২ কিলোমিটার। এ অংশে ১৬টি স্টেশন থাকবে এবং ৩০ হাজার যাত্রী বহন করবে।
বিআরটি-৭ : এটি হবে পূর্বাচল থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। এ প্রকল্পেরও প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়নি।
৩টি রিং রোড : ইনার, মিডল ও আউটার নামে তিনটি রিং রোড করবে ডিটিসিএ। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। ইনার রিং রোডের দৈর্ঘ্য হবে ৭৩ কিলোমিটার। তেরমুখ থেকে শুরু হয়ে আবদুল্লাহপুর, গাবতলী, রায়েরবাজার, বাবুবাজার, সদরঘাট, ফতুল্লা, চাষাঢ়া, সাইনবোর্ড, সিমরাইল, ডেমরা, বালু নদীতে গিয়ে শেষ হবে। আর মিডল রিং রোডের দৈর্ঘ্য হবে ১০৮ কিলোমিটার। আউটপাড়ায় শুরু হয়ে ঢাকা বাইপাস, ভুলতা, কাঞ্চনপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঝিলমিল, ওয়েস্টার্ন বাইপাসে গিয়ে শেষ হবে। আউটার রিং রোডের দৈর্ঘ্য হবে ১২৯ কিলোমিটার। হেমায়েতপুর থেকে শুরু হয়ে কালাকান্দী হয়ে মদনপুর, ডেমরা, বাইপাইল ও গাজীপুরে গিয়ে শেষ হবে।
আটটি রেডিয়াল সড়ক : সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আটটি রেডিয়াল সড়ক করবে ডিটিসিএ। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা থেকে জয়দেবপুর, ঢাকা-টঙ্গী-ঘোড়াশাল, ঢাকা-পূর্বাচল-ভুলতা, ঢাকা-কাঁচপুর-মেঘনা সেতু, ঢাকা-সাইনবোর্ড-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-ঝিলমিল-ইকুরিয়া, ঢাকা-আমিনবাজার-সাভার, ঢাকা-আশুলিয়া-ডিইপিজেড।
৬টি এক্সপ্রেসওয়ে : ডিটিসিএ ৬টি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সুপারিশ করেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-চট্টগ্রামওয়ে, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-ময়মনসিংহ এক্সপ্রেসওয়ে।
২১টি ট্রান্সপোর্টেশন হাব : আরএসটিপির আওতায় ২১টি ট্রান্সপোর্টেশন হাব নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, মহাখালী বাসটার্মিনাল, যাত্রাবাড়ী বাসটার্মিনাল, গাবতলী সার্কুলার ওয়াটারওয়ে স্টেশন ও সদরঘাট লঞ্চটার্মিনাল।
বৃত্তাকার জলপথ উন্নয়ন প্রকল্প : যানজট নিরসনে ঢাকার চারপাশে জলপথ উন্নয়নের প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ রাখা হয়েছে আরএসটিপিতে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ওয়াটার ট্যাক্সি, ওয়াটার বোর্ড, লঞ্চে নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হবে।
প্রসঙ্গত, ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার পরিকল্পিত, সমন্বিত এবং আধুনিক ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ১৯৯৮ সালে ‘গ্রেটার ঢাকা ট্রান্সপোর্ট প্লানিং অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশন বোর্ড’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ২০০১ সালে এটিকে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড (ডিটিসিবি) নামে নামকরণ করা হয়। আর সর্বশেষ ২০১২ সালে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) নামে পুনর্গঠন করা হয়। এ সংস্থাটি এখন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী জেলার ৭ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও যানজট নিরসন নিয়ে কাজ করছে। ২১ বছর ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও আশানুরূপ কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি। এ প্রতিষ্ঠানের ৩১ সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে।