ভোলায় ৩টি কূপ খনন
গ্যাজপ্রম উচ্চমূল্যে কাজ পাচ্ছে
সক্ষমতা থাকার পরও বাপেক্সকে বসিয়ে রেখে বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দেয়া হচ্ছে * এ ধরনের একটি কূপ খননে বাপেক্সের ব্যয় হবে সর্বোচ্চ ১০ মিলিয়ন ডলার * ‘হ্রাসকৃত মূল্যে’র নির্দেশনা লঙ্ঘন
মুজিব মাসুদ
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে বাদ দিয়ে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ উচ্চমূল্যে ভোলায় ৩টি গ্যাসকূপ খননের কাজ দেয়া হচ্ছে রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে।
৩টি কূপের মধ্যে দুটি অনুসন্ধান ও একটি অ্যাপ্রাইজাল-উন্নয়ন। এ জন্য দেয়া হচ্ছে ৬৩ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৪০ কোটি টাকা।
গড়ে প্রতিটি কূপ খননে ব্যয় হচ্ছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৭৮ কোটি টাকা। এর আগে দেশে কোনো গ্যাসকূপ খননে এত ব্যয় হয়নি।
খোদ রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স এ ধরনের একটি কূপ খননে সর্বোচ্চ ব্যয় করেছে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৮৫ কোটি টাকা।
বাপেক্স কূপ তিনটি আবিষ্কার করে। তাদের নকশা অনুযায়ী গ্যাজপ্রম কাজ করবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় এ কাজ দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে জ্বালানি সচিবের নেতৃত্বাধীন প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটি (পিপিসি)।
জানা গেছে, সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় হয়ে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে যাবে। ওই কমিটির অনুমোদনের পর চূড়ান্ত অনুমোদন দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
পিপিসির সিদ্ধান্তের পর উচ্চপর্যায়ের এই অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে পিপিসির সভাপতি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ৪ বছর আগের দর আর এখনকার দর কোনোভাবেই এক হবে না।
৪ বছরে কূপপ্রতি সর্বোচ্চ ২-৩ মিলিয়ন ডলার করে দাম বেড়েছে। এটা কোনোভাবে বেশি দর বলা যাবে না। এ ছাড়া কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী এ ধরনের বড় বিনিয়োগে আসতে রাজি হচ্ছে না।
গ্যাসপ্রমের সঙ্গে ৫ দফা বসে এই দর ঠিক করা হয়েছে। তাদের দেয়া প্রস্তাব থেকে আমরা আরও অনেক কমিয়ে এটি নির্ধারণ করেছি। তিনি বলেন, ৩টি কূপ খননে ৫৩.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে।
অর্থাৎ, একটি ১৮ মিলিয়ন, বাকি দুটির মধ্যে একটি ১৭.৬ মিলিয়ন অপরটি ১৭.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার করে। বাকি ১০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে রিগ ভাড়া, জনবল ও থার্ড পার্টি পরিষেবায়।
এর আগে বাপেক্স ১৯.৫ মিলিয়ন ডলারে কূপ খনন করেছে। কাজেই এই দরকে রেকর্ড পরিমাণ বেশি বৃদ্ধি বলা ঠিক হবে না।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি বাপেক্স সম্প্রতি ভোলায় একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে।
সেখানে একাধিক কূপও খনন করেছে বাপেক্স। গ্যাজপ্রমকে এখন যে তিনটি কূপ খননের কাজ দেয়া হচ্ছে সেগুলোও বাপেক্সের দেয়া ভূতাত্ত্বিক কারিগরি নির্দেশনা (জিওলজিক্যাল টেকনিক্যাল অর্ডার বা জিটিও) অনুসরণ করে, বাপেক্সের নির্ধারণ করে দেয়া স্থানেই (লোকেশন) গ্যাজপ্রম খনন করবে।
কূপ খননের জন্য বাপেক্সের রিগসহ সব ধরনের যন্ত্রপাতিও রয়েছে। এরপরও এ ধরনের এলাকায় কূপ খননের কাজ বাপেক্সকে না দিয়ে দেয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিকে।
খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেছেন, বাপেক্স ওই এলাকায় ইতোমধ্যে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করেছে।
এ কারণে কূপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্যই তাদের কাছে রয়েছে। কূপ খননের জন্য রিগসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং জনবলও বাপেক্সের আছে।
এ ধরনের একেকটি কূপ খনন করতে বাপেক্সের ব্যয় হবে সর্বোচ্চ ১০ মিলিয়ন ডলার (রিগ ভাড়া, জনবলের পেছনে ব্যয়, থার্ড পার্টির সেবাসমূহের ব্যয় প্রভৃতিসহ)।
বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশে উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তির অধীন তিনটি ব্লকে দীর্ঘদিন কর্মরত আমেরিকান কোম্পানি শেভরনের প্রতিটি কূপ খননে গড় ব্যয় ১৭ মিলিয়ন ডলারের মতো।
গ্যাজপ্রম এর আগে একাধিক চুক্তির আওতায় মোট ১৭টি কূপ খনন করেছে। এর মধ্যে প্রথম ১০টির চুক্তিমূল্য ছিল প্রায় ১৯৩ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অর্থাৎ প্রতিটি কূপের চুক্তিমূল্য ছিল ১৯ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। এরপর সর্বশেষ যে কূপগুলো তারা (গ্যাজপ্রম) খনন করেছে তার প্রতিটির চুক্তিমূল্য ছিল ১৬ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলার।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য বর্তমান ৩টি কূপ খননের যে প্রস্তাব সারসংক্ষেপ আকারে পাঠায় তাতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়: গ্যাজপ্রম হ্রাসকৃত মূল্যে এই তিনটি কূপ খনন করবে।
প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেন। কিন্তু এখন ৩টি কূপের যে চুক্তিমূল্য চূড়ান্ত করা হয়েছে, তা বাংলাদেশে গ্যাসকূপ খননে সর্বোচ্চ মূল্যের রেকর্ড করেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এই কূপগুলো খননে সম্পূর্ণ সক্ষম।
এ অবস্থায় কোনো যুক্তিতেই রেকর্ড পরিমাণ মূল্যে এ কাজ অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেয়া যৌক্তিক নয়।
দামের বিবেচনায় যেমন তেমনি বাপেক্সকে বসিয়ে রেখে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এ কাজ করানোর বিবেচনাও জাতীয় স্বার্থবিরোধী হবে।
অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, গ্যাজপ্রমের সহযোগিতা আমাদের দরকার চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। তাদের সহযোগিতা দরকার গভীর কূপ খননে, সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধানে।
তার পরিবর্তে বাপেক্সের আবিষ্কৃত ক্ষেত্র, বিশেষ করে ভোলা এবং অন্যান্য বিদ্যমান ক্ষেত্রে বেশি মূল্যে কূপ খনন করার মতো বেনিয়া মনোবৃত্তি গ্যাজপ্রমের যেমন থাকা অনুচিত তেমনি আমাদেরও উচিত এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গ্যাজপ্রম গত বছরের ২৫ মে ভোলার ওই তিনটি (টবগি-১, ইলিশা-১ ও ভোলা নর্থ-২) খননের জন্য ৬৫ দশমিক ০৮৫২১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দর প্রস্তাব করে।
প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করার জন্য একটি কারিগরি উপকমিটি গঠন করা হয়। এই উপকমিটি কয়েক দফা আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষি শেষে ৬৩ দশমিক ৫৮৫২১৮ মিলিয়ন ডলার দর চূড়ান্ত করে তা পিপিসির কাছে উপস্থাপন করে।
গত ২৭ আগস্ট জ্বালানি সচিবের সভাপতিত্বে পিপিসির সভায় এ দাম সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর সভার কার্যবিবরণী প্রকাশ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অপারগ ওই সূত্র জানায়, এই কূপ তিনটি খননে অস্বাভাবিক ব্যয়ের যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে- ভোলা ক্ষেত্রে গ্যাসের চাপ (রিজার্ভার প্রেসার) বেশি, ৪৫০০ থেকে ৫০০০ পিএসআই থাকায় সেখানে কূপ খনন করা ঝুঁকিপূর্ণ।
তাছাড়া, এ কাজের জন্য গ্যাজপ্রমকে ড্রিলিং কন্ট্রাক্টরসহ ৬টি ইঞ্জিনিয়ারিং সেবা (ডিএসটি, সিমেন্টিং, মাড লগিং, ওয়্যারলাইন লগিং, টেস্টিং অ্যান্ড কমপ্লিশন) বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
কোভিড-১৯জনিত পরিস্থিতির কারণে সমুদ্র ও আকাশপথে চলাচল স্বাভাবিক না থাকায় মালামাল ও জনবল আনা-নেয়ার ব্যয়ও বাড়বে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অপর একটি সূত্র জানায়, কূপ তিনটি বাপেক্স খনন করলেও ওই ইঞ্জিনিয়ারিং সেবাগুলো তাদেরও একই প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করতে হতো।
আর এই কাজের জন্য বিদেশ থেকে হাজার হাজার টন মালামাল আনা কিংবা শত শত লোক আনা-নেয়ারও কোনো বিষয় নেই, যাতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় বেড়ে যাবে।
আর অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ব্যয় বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে কারিগরি উপকমিটি কিংবা পিপিসি যেমনটি বলছে, অবস্থা যদি তেমনই হয় তাহলে এখন ভোলায় এই কূপ তিনটি না করলেও চলে।
কেননা, সেখানে বিদ্যমান যে কূপগুলো রয়েছে তার পূর্ণ ব্যবহারই এখন পর্যন্ত হচ্ছে না। এখন নতুন তিনটি কূপ হলেও তা অব্যবহৃতই থাকবে।
ভোলার গ্যাস অদূর ভবিষ্যতে দেশের মূল ভূখণ্ডে সরবরাহ করা যাবে কিংবা এই তিনটি কূপ খনন করা হলেই জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো যাবে-বিষয়টি তেমনও নয়।
কাজেই ভোলার দায়িত্ব বাপেক্সের হাতে ছেড়ে দিয়ে গ্যাজপ্রমকে অন্যত্র কাজে লাগানোর পদক্ষেপ নিলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।