
প্রিন্ট: ০২ এপ্রিল ২০২৫, ০১:১৩ এএম
হেভিওয়েট প্রার্থী জাফরউল্লাহর পথের কাঁটা নিক্সন চৌধুরী

জাহিদ রিপন, ফরিদপুর ব্যুরো
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০১৮, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
জেলার ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন উপজেলা নিয়ে ফরিদপুর-৪ আসনটি নানা কারণে আলোচিত। সবশেষ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে চমক দেখান স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। আগামী নির্বাচনেও নিক্সন চৌধুরী আ’লীগের একটি অংশকে কব্জায় রেখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচার চালাচ্ছেন। বসে নেই বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও। ফরিদপুর-৪ আসনটিতে আগামী নির্বাচনেও আ’লীগ ও বিএনপি প্রার্থীদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছেন নিক্সন চৌধুরী। গতবার পরাজয়ের কারণ হিসেবে দলীয় কোন্দলকে দায়ী করা হলেও তিন উপজেলাতেই সেই কোন্দল বিদ্যমান বলে অভিযোগ রয়েছে। আ’লীগের একটি অংশ নিক্সন চৌধুরীর পক্ষে থাকলেও অপর অংশটি সাবেক এমপি কাজী জাফরউল্লাহর পক্ষে। গত নির্বাচনে অংশ না নিলেও আগামী নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী একাধিক। এরই মধ্যে জাকের পার্টি গোলাপ ফুল প্রতীকে ভোটের ঘোষণা দিয়েছেন। বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচারে জমে উঠেছে নির্বাচনী প্রচার। মোড়ে মোড়ে রঙিন পোস্টার আর ব্যানারে সয়লাব। চলছে সভা-সমাবেশও।
বিশেষ করে নব্বইয়ের পর প্রথম ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে এমপি হন কাজী জাফরউল্লাহর চাচা আ’লীগের ড. কাজী আবু ইউসুফ। ১৯৯৬ সালের ভোটেও আবু ইউসুফ বিজয়ী হন। ২০০১ সালের ভোটে এমপি হন কাজী জাফরউল্লাহ। ২০০৮ সালে জাফরউল্লাহর স্ত্রী স্থপতি নিলুফার জাফরউল্লাহ জয়ী হন। ২০১৪ সালের ভোটে জাফরউল্লাহকে বিপুল ভোটে হারান মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। নিক্সন চৌধুরী ৯৮ হাজার ৫৯৪ ভোট পান ও জাফরউল্লাহ পান ৭২ হাজার ২৪৮ ভোট।
সূত্র বলছে, বেশিরভাগ সময়ই এ আসনে জয়ী হন আ’লীগ প্রার্থীরা। তবে দলীয় কোন্দলের কারণে আ’লীগের ঘাঁটিতে ভোট বেড়েছে বিএনপির। গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় এবং আ’লীগের কোন্দলের সুযোগে জয় লাভ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরী। তিন উপজেলার মধ্যে ভাঙ্গা ও সদরপুরে আ’লীগের ভোট বেশি। চরভদ্রাসনে বিএনপির ভোট বেশি। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে কোন্দল মেটাতে জাফরউল্লাহ কাজ করছেন। আ’লীগ ত্যাগী নেতাদের কাছে টেনে নিচ্ছে। এদিকে জোর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন এমপি নিক্সন চৌধুরী। সমাবেশ করে উন্নয়নের ফিরিস্তির কথা তুলে ভোটারদের মন জয়ের নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিন উপজেলার বেশিরভাগ ইউপি চেয়ারম্যানকে কাছে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছেন নিক্সন চৌধুরী।
নানামুখী চাপে থাকা বিএনপি প্রার্থীরাও মাঠে সক্রিয়। প্রচারে ব্যস্ত রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও ভাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার ইকবাল হোসেন সেলিম, জাসাস কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি শাহরিয়ার ইসলাম শায়লা। জাকের পার্টির প্রেস সচিব শামীম হায়দার বলেছেন, জাকের পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা আমীর ফয়সাল ভোট করবেন। ৩০০ আসনেই জাকের পার্টি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী কাজী জাফরউল্লহর সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, গত ৭টি সংসদ নির্বাচনে আমাদের পরিবার থেকে নৌকা প্রতীকে এমপি হন। শুধু গত নির্বাচনে হেরে যাই। বিজয়ী হন নিক্সন চৌধুরী। পরে তিনি বলেছিলেন আগামীতে তিনি নৌকা প্রতীক এনে নির্বাচন করবেন। তিনি নৌকা আনতে পারেননি। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৩ বিদ্রোহী এমপিকে জননেত্রী শেখ হাসিনা দলে নিলেও নিক্সন চৌধুরীকে নেননি। এতেই প্রমাণ করে তিনি নৌকার লোক নন। মানুষের কাছে তার বিভ্রান্তি ধরা পড়ে গেছে। তাই জনগণ এবার নৌকাকে বিজয়ী হিসেবে দেখতে চায়। এজন্য আমি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আগামী নির্বাচনে আমি নৌকার বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারব ইনশাআল্লাহ।
কথা হয় বর্তমান এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আগে যারা এমপি হয়েছেন তারা শুধু মনোনয়ন বাণিজ্যসহ নানা ভাবে লাভবান হয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়েছেন। পানামা কেলেঙ্কারিতে কাজী জাফরউল্লাহসহ পরিবারের নাম আছে। তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে এলাকার উন্নয়নে তেমন কোনো কাজ করতে পারেননি। আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এলাকার জনগণ এজন্য মাত্র ২৬ দিনের প্রচারে আমাকে না দেখে কাজী পরিবারের বিরুদ্ধে বিপুল ভোটের ব্যবধানে আমাকে এমপি নির্বাচিত করছেন। গত সংসদ নির্বাচনে কাজী পরিবারের বিপক্ষে দাঁতভাঙা জবাব দিয়ে আমাকে এমপি বানিয়েছেন। এলাকার উন্নয়নে কাজ করছি। বিদ্যুৎ, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ করে মানুষের মনে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছি। তাই আগামী নির্বাচনে নৌকা পেতে তেমন কষ্ট হবে না বলে আশা করছি। আমি নৌকার বিপক্ষের লোক নই আমার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। আমার সঙ্গে নৌকা ও আওয়ামী লীগের কোন দ্বন্দ্ব নেই। ওই কাজী পরিবারের কাছ থেকে নৌকা উদ্ধার করে সঠিক ঘাটে না নেয়া পর্যন্ত চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
এ আসনে বিএনপির ভোট ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আগে আসনটি শুধু ভাঙ্গা উপজেলা নিয়ে গঠিত থাকার আ’লীগের একক আধিপত্য ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে সদরপুর ও চরভদ্রাসন যোগ হওয়ায় বিএনপির ভোট বেড়েছে। বিএনপির স্থানীয় নেতারা মনে করেন, আ’লীগের কোন্দলকে কাজে লাগাতে পারলে বিএনপির জয় অসম্ভব কিছু নয়। গত নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন। গত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির দুই প্রার্থী শাহরিয়ার ইসলাম শায়লা ২৮ হাজার ৩০০ এবং ইকবাল হোসেন সেলিম ২৭ হাজার ৪৩৪ এবং জামায়াতের নারী প্রার্থী পেয়েছিলেন প্রায় ৯ হাজার ভোট। সব মিলিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের ভোট প্রায় ৬৪ হাজার। এসব সমীকরণ সামনে নিয়ে অনেকেই বলছেন আগামী নির্বাচনে লড়াই হবে ত্রিমুখী।
জানতে চাইলে বিএনপি নেতা ইকবাল হোসেন সেলিম যুগান্তরকে বলেন, হাইকমান্ডের সবুজ সংকেত পেয়ে ৩ উপজেলার নেতাকর্মীদের সংগঠিত করছি। তৃণমূল নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে আছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর কোনো নেতাকে এলাকায় দেখা না গেলেও আমি ঝুঁকি নিয়ে মানুষের কাছে গেছি। তাদের খোঁজখবর নিয়েছি। বন্যা-শীত ও নদী ভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায় মানুষের মাঝে গিয়ে তাদের সুখ-দুঃখে শামিল হয়েছি। এছাড়া সামাজিক কাজে সাধ্যমতো সহযোগিতা করছি। গেল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা ভোট কেটে নেয়ার পরও প্রায় ৩০ হাজার ভোট পাই। তিনি বলেন, এ আসনে আ’লীগের ভোট ভাগ হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি জয়লাভ করবে।
জাসাস নেতা শাহরিয়ার ইসলাম শায়লা যুগান্তরকে বলেন, দলীয় হাইকমান্ড যে সিদ্ধান্ত নেবে তা মেনে নেব। এলাকায় আমার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আমি ২৮ হাজারের বেশি ভোট পাই। এছাড়া আামি একজন নারী, আর এ আসনে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি। তাই আমাকে মনোনয়ন দিলে নানা সুবিধা পাব। দলের মনোনয়নের ব্যাপারে আশি আশাবাদী। এলাকার অসঙ্গতি দূরীকরণের পাশাপাশি নানা সামাজিক কাজে আমি নিজেকে সব সময় নিয়োজিত রাখি। বেশিরভাগ সময় রাজনীতির পেছনে ব্যয় করি। মনোনয়ন পাই বা না পাই সারা জীবন দলের জন্য কাজ করে যাব।