হলমার্কের ঋণ কেলেঙ্কারি: কমিশনের টাকায় বিলাসী জীবন হুমায়ুনের
দুদকের ৩৭ মামলার আসামি সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবিরের সেকেন্ডহোম মালয়েশিয়া * মালয়েশিয়া-কানাডা যাতায়াত প্রতি মাসে * দুই দেশেই আছে সম্পদ, পাহারার জন্য আছে আলাদা লোক * ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি হুমায়ুন কবিরের অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন দিতে পারে : পিপি
মিজান মালিক
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ুন কবির বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। নিয়ম ভেঙে হলমার্ক গ্রুপকে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ পাইয়ে দেয়ার ঘটনা ফাঁস হলে দুদক মামলা করে।
এ মামলা থেকে বাঁচতে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। প্রথমে মালয়েশিয়ায় আত্মগোপন করেন। সেখান থেকে যাতায়াত শুরু করেন কানাডায়।
মালয়েশিয়া ও কানাডা- দু’দেশেই থাকেন নিজস্ব প্রাসাদোপম বাড়িতে, চলাচল করেন বিলাসবহুল গাড়িতে। দেশ দুটিতেই তিনি সম্পদও গড়েছেন। সেই সম্পদ দেখাশোনার জন্য আলাদা লোকও রেখেছেন। তার দুই মেয়ে পড়াশোনা করছে কানাডায়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সূত্র জানায়, হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা ৩৭ মামলায় ওয়ারেন্ট আছে। দেশে এলেই গ্রেফতার হবেন এই আশঙ্কায় তিনি বিদেশেই নিরাপদ মনে করছেন। তবে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য নানা মাধ্যমে চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে সহায়তা চেয়ে দুদকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) চিঠি দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব মুহম্মদ দিলোয়ার বখত যুগান্তরকে বলেন, পলাতক আসামিদের গ্রেফতারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা থাকে। সোনালী ব্যাংকের সাবেক এই এমডির বিষয়ে বলেন, তিনি কোন দেশে আছেন, তা আমরা নিশ্চিত হতে পারলে ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ নিতে পারব।
হলমার্ক মামলায় দুদকের পক্ষে নিয়োজিত পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম যুগান্তরকে বলেন, হুমায়ুন কবিরসহ ব্যাংকের ৮-১০ কর্মকর্তা এখনও গ্রেফতার হয়নি। শুনেছি হুমায়ুন কবির দেশের বাইরে চলে গেছেন। তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রসিকিউশন কি করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওয়ারেন্ট তামিল করা যেতে পারে।
এদিকে এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। মালয়েশিয়া ও কানাডাও এ গ্রুপের সদস্য। ফলে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী দুই দেশেই বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে চিঠি দিয়ে তার সম্পদের ব্যাপারে তথ্য চাইতে পারে বলে মনে করছেন দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা।
তবে মামলার তদন্তকারী সংস্থা দুদক থেকে এ ব্যাপারে তথ্য চাইতে হবে বিএফআইউর কাছে। দুদকের চিঠি পেলেই এফআইইউ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানান এক কর্মকর্তা।
তবে এই প্রক্রিয়ায় পাওয়া তথ্য আদালতে ব্যবহার হবে কিনা তা তথ্য পাওয়ার ওপর নির্ভর করছে। দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) মাধ্যমে এসব তথ্য আনা সম্ভব। সেগুলো আদালতেও ব্যবহার করা যাবে। ইতিমধ্যে বিএফআইইউ থেকে মালয়েশিয়া ও কানাডার সঙ্গে এমওইউ করা হয়েছে।
জানা যায়, হলমার্ক গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় দুদক এখন পর্যন্ত ৩৭টি মামলা করেছে। এসব মামলায় হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, এমডি তানভির মাহমুদ, সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবিরকে আসামি করা হয়। এছাড়া ব্যাংকের আরও ২০ কর্মকর্তাসহ তানভীরের কয়েক আত্মীয়কেও এ মামলায় আসামি করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্টে দেখা যায়, সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংক ও তাদের গ্যারান্টিতে দেশের ২৬টি ব্যাংক থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে হলমার্ক গ্রুপ। এ কাজে হলমার্ক গ্রুপকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেন ব্যাংকটির সাবেক এমডি হুমায়ুন কবির।
অনুসন্ধান ও ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঋণের বিপরীতে হলমার্ক গ্রুপের কাছ থেকে হুমায়ুন কবির কমপক্ষে ১০ পার্সেন্ট কমিশন নিয়েছেন। ঘটনার পরই ওই টাকা তিনি মালয়েশিয়া ও কানাডায় পাচার করেন।
এসব অর্থে তিনি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোমের মালিক হয়েছেন বলে জানা গেছে। মালয়েশিয়া ছাড়াও কানাডায় বাড়ি, গাড়িসহ নানা সম্পদ গড়েছেন। হলমার্ক গ্রুপ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন গ্রাহকের ঋণের নামে বেআইনিভাবে অনেক অর্থ হাতিয়ে নেন।
পেশাদার বাণিজ্যিক ব্যাংকার না হয়েও শুধু প্রভাব খাটিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের এমডি হন হুমায়ুন কবির। তিনি ছিলেন সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) এমডি। শুরু থেকেই তার নিয়োগ নিয়ে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ ছিল। কারণ এর আগে তিনি বড় কোনো ব্যাংকের এমডি বা ডিএমডি পদেও ছিলেন না।
২০১০ সালের ২০ মে থেকে ২০১২ সালের মে পর্যন্ত তিনি সোনালী ব্যাংকের এমডি পদে ছিলেন। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনাটি ঘটেছে ওই সময়েই। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা জানাজানি হলে পর্ষদ ভেঙে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। তবে এরই মধ্যে তার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
অর্ভিযোগের বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে তিনি ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে একবার দুদকে হাজির হয়েছিলেন। দুদক কঠোর অবস্থানে আছে টের পেয়েই তিনি দেশ ছাড়েন।
হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় তানভির ও জেসমিন ইসলামের পরই ব্যাংকার হিসেবে দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে তিনি দুদকে সম্পদ বিবরণী দেয়া বা মামলার আগেই দেশত্যাগ করেন বলে সূত্রটি জানায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী সৎ ও দক্ষ হলে কোনো ব্যাংকেই বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটতে পারে না। কেননা ব্যাংক থেকে টাকা কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে তা বিশ্লেষণ করলেই জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে যাবে। হলমার্কের ঘটনাটি তার জ্ঞাতসারেই হয়েছে। এতে তিনি বড় অপরাধ করেছেন। এর কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। একটি ঘটনার শাস্তি হলে নতুন করে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর কেউ সাহস পাবে না।
তিনি আরও বলেন, আমরা শুনেছি ব্যাংকের টাকা মেরে অনেক ব্যাংকার পালিয়ে বিদেশে গিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। তারা সেখানে বাড়ি-গাড়ি করার পাশাপাশি ব্যবসাও করছেন। এগুলো আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সব ফেরত আনা সম্ভব। তবে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
সোনালী ব্যাংকের সূত্র জানায়, হুমায়ুন কবির দায়িত্বে থাকার সময় ব্যাংক থেকে প্রায়ই রাত ৮-৯টার দিকে বের হতেন। হাতে থাকত একটি বড় ব্রিফকেস। এতে নগদ টাকা থাকত বলে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনেকে জানিয়েছেন।
ওইসব টাকা পরে তিনি ডলার করে নানা প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার করেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। সেই টাকার বড় অংশ প্রথমে গেছে মালয়েশিয়ায়। আর কিছু অংশ গেছে কানাডায়। ওইসব অর্থ বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ করে আরও সম্পদের মালিক হন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভির ও চেয়ারম্যান জেসমিন ও সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলার বিচার চলছে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে। অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে এসব মামলা হয়। ২০১৬ সালে বিচার কাজ শুরু হলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এখনও বিচার শেষ হয়নি।
সূত্র জানায়, ১০ পার্সেন্ট কমিশন নিয়ে ৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকাই জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করেন হুমায়ুন কবির। কমিশনের টাকাই তিনি দেশের বাইরে পাচার করেন। এছাড়া দেশেও বেনামে বিভিন্নভাবে টাকা বিনিয়োগ করেন।
হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে হলমার্ক ঋণ জালিয়াতি মামলার বিচারের বিষয়ে দুদকের পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম যুগান্তরকে বলেন, প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে বিচার চলছে। মামলায় হলমার্কের এমডি তানভির ও চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ বেশ কয়েকজন আসামি জেলে রয়েছে। হুমায়ুন কবির পলাতক থাকায় তাকে পলাতক দেখিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি আত্মসমর্পণ না করলে তার অনুপস্থিতিতেই মামলার বিচার নিষ্পত্তি হবে।
পিপি বলেন, হুমায়ুন কবিরসহ যেসব আসামি বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন না, তারা নিজেরাই অপরাধ স্বীকার করে নিচ্ছেন। কাজেই আদালতে আত্মসমর্পণের পর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের প্রয়োজন মনে করছেন না।
এদিকে হুমায়ুন কবির ও তার স্ত্রী আয়েশা আক্তার রীতার অবৈধ সম্পদ নিয়ে দুদক থেকে পৃথকভাবে অনুসন্ধান শুরু করা হয় ২০১৬ সালেই। অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপপরিচালক সৈয়দ আহমেদ রাসেলকে নিয়োগ দেয়া হয়।
অনুসন্ধান শুরু হলে হুমায়ুন কবিরের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ করে দুদক। নোটিশ জারির পর পলাতক হুমায়ুন কবির এক ব্যক্তির মাধ্যমে সম্পদের বিবরণী দাখিল করেন বলে জানা গেছে।
সম্পদ বিবরণী সূত্রে জানা যায়, হুমায়ুন কবির ও তার স্ত্রী আয়েশা আক্তার রীতার নামে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে হুমায়ুন কবিরের নামে ১ কোটি ৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা ও তার স্ত্রীর নামে ১ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য প্রকাশ করা হয়।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, হুমায়ুন কবির ও তার স্ত্রীর অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ২০১৮ সালের নভেম্বরে কমিশনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে বলা হয়, তাদের আয়কর নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঘোষিত সম্পদ বিবরণীর সঙ্গে ১ লাখ ২৪ হাজার ২৭৮ টাকার সম্পদের পার্থক্য বা তারতম্য আছে।
প্রতিবেদনে দু’জনের দাখিল করা সম্পদ বিবরণী সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেও উল্লেখ করা হয়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি- এ মর্মে মতামত দেন কর্মকর্তা। এ অবস্থায় দুদকের পক্ষ থেকে ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে পুনঃঅনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।