
প্রিন্ট: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৩২ এএম
আ’লীগ মরিয়া আসন ধরে রাখতে বিএনপি চায় পুনরুদ্ধার

আখতারুজ্জামান আখতার, পাবনা ও আলাউদ্দিন আহমেদ, ঈশ্বরদী
প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
জেলার আটঘরিয়া ও ঈশ্বরদী উপজেলা নিয়ে পাবনা-৪ সংসদীয় আসনে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে নানামুখী কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করছেন। যোগ দিচ্ছেন সভা-সমাবেশ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। অনেকে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। ফেসবুকে নির্বাচনী পরিকল্পনা তুলে ধরে পোস্ট দেয়াসহ এসএমএসের মাধ্যমেও নিজেকে তুলে ধরছেন অনেকে। ৩ লাখ ৬৫ হাজার ভোটারের আসনটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির বাড়িও এ এলাকার। একসময় জেলা বিএনপির সভাপতির বাড়িও ছিল এ এলাকায়। এ আসনে আ’লীগের প্রভাবই বেশি। বিশেষ করে নব্বইয়ের পটপরিবর্তনের পর মোটাদাগে পাঁচটি নির্বাচন হলেও চারটিতেই জয়ী হন আ’লীগের শামসুর রহমান শরিফ ডিলু। তিনি শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি এ আসনের শক্ত প্রার্থী।
এ আসনে ১৯৯১ সালের ভোটে এমপি হন বিএনপির সিরাজুল ইসলাম সরদার। ১৯৯৬ সালে বিজয়ী হন আ’লীগের শামসুর রহমান শরীফ। এর পরের তিন তিনটি নির্বাচনে অর্থাৎ ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের ভোটে এমপি হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুর রহমান শরীফ ডিলু।
নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে কথা হয় শামসুর রহমান শরিফের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মানুষের অবস্থার উন্নয়নে কাজ করাই আমার প্রধান লক্ষ্য। ঈশ্বরদী ও আটঘরিয়ার এমপি হিসেবে সরকার নির্ধারিত অনেক উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করেছি। এ অঞ্চলে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ হবে। রূপপুর দিয়ে দেশ আলোকিত হবে। ঈশ্বরদী-ঢালারচর রেললাইন প্রকল্পও আরেকটি বৃহৎ প্রকল্পের কাজ শেষের দিকে। অচিরেই রাজশাহী থেকে ঈশ্বরদী হয়ে পাবনা অভিমুখে ট্রেন চলাচল করবে। মানুষ এখন উন্নয়নের সুবিধা পাচ্ছে। সরকারের ধারাবাহিকতা থাকলে উন্নয়নের গতি আরও বৃদ্ধি পাবে।
জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সাবেক এমপি পাঞ্জাব আলী বিশ্বাস দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। ১৯৮৬ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল থেকে এ আসনে সর্বকনিষ্ঠ এমপি হয়ে হইচই ফেলে দেয়া এ নেতা অত্যন্ত সুবক্তা হিসেবে পরিচিত। গত নির্বাচনে তিনি সভানেত্রীর নির্দেশে পাবনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের শামসুল হক টুকুর জন্য কাজ করেন এবং তাকে জয়ী হতে সহায়তা করেন। আলাপকালে পাঞ্জাব বিশ্বাস যুগান্তরকে বলেন, নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে এ এলাকায় দল বহুভাগে বিভক্ত। দলীয় পরিচয়ে দুর্বৃত্তায়ন জনগণের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। জনগণের আকাক্সক্ষা নেত্রীর উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাথতে স্বচ্ছ নেতৃত্বের বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম লিটন নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা দিয়ে গণসংযোগ করছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মনোনয়ন পেয়ে জয়ী হলে এলাকার গণমানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কর্মসংস্থানের দিকে নজর দেব। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখব। আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রবিউল আলম বুদু একাধিকবার সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন। অ্যাডভোকেট বুদু যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান সরকার যেভাবে উন্নয়ন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাতে আগামী নির্বাচনে নৌকার বিজয় হবেই। নতুন প্রজন্মের নেতা হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হলে সামগ্রিক উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখব।
কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী লীগের সহসভাপতি বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সমাজসেবক প্রকৌশলী মো. আবদুল আলীম। তিনি নানা জনহিতকর কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আলীম যুগান্তরকে বলেন, মনোনয়ন পেলে প্রধানমন্ত্রীর ভিশন-২১ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিরলস কাজ করে যাব। তাছাড়া নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বই পারে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে।
আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসনটি বিএনপি তাদের দখলে নিতে চায়। মামলা-হামলায় কাবু দলটির বেশ কয়েকজন নেতা এরই মধ্যে মাঠ গোছানোর কাজ করার পাশাপাশি প্রচার কাজেও নেমে পড়েছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মনোনয়নপ্রত্যাশী যেসব নেতা মাঠে সক্রিয় তাদের মধ্যে রয়েছেন- সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম সরদার, বিএনপি নেতা ও বিশিষ্ট শিল্পপতি আকরাম আলী খান সঞ্জু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, সাবেক পৌর মেয়র মকলেছুর রহমান বাবলু ও পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টু।
তাদের মধ্যে হাবিবুর রহমান হাবিব ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েও মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হন। ওই নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের শামসুর রহমান। এলাকায় প্রচার রয়েছে, শেষ পর্যন্ত হাবিব ও সিরাজের দ্বন্দ্বের কারণেই ওই নির্বাচনে পরাজিত হয় বিএনপি। আগামী নির্বাচনে ২০ দল জোটবদ্ধ নির্বাচন করলে জামায়াত নেতা আবু তালেব মণ্ডল মনোনয়ন চাইবেন। এরই মধ্যে তিনি স্থানীয় গণমাধ্যমে শুভেচ্ছা জানিয়ে ঈশ্বরদী-আটঘরিয়ার ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।
সূত্র বলছে, আগামী নির্বাচনেও মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদী জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম সরদার। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি মাঠের বাইরে আছেন। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য নেয়ার জন্য বারবার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বিএনপির অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী শিল্পপতি সঞ্জু খানের সমর্থকদের দাবি, সিরাজ এবং হাবিবের দ্বন্দ্বের কারণে অতীতে দল হেরেছে। তাই এবার সঞ্জুকেই তারা পছন্দ করছেন। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবেও তিনি পরিচিত। সঞ্জু খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি চাই বিএনপির হাত শক্তিশালী হোক এবং আগামীতে বিএনপি এককভাবে ক্ষমতায় আসুক। এ লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। আমার ব্যক্তিগত চাওয়ার কিছু নেই। তবে তৃণমূল এবং হাইকমান্ড আসনটি পুনরুদ্ধার করতে আমাকে মনোনয়ন দিলে আমি প্রস্তুত।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা হাবিবুর রহমান হাবিবের সমর্থকদের দাবি, এবার মনোনয়ন পাবেন তিনি। কথা হয় হাবিবুর রহমান হাবিবের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ভালো কাজের জন্য ভালো পরিবেশ দরকার। একটি পক্ষকে দমনপীড়ন করে একতরফা নির্বাচন করলে দেশের মঙ্গল হবে না। দলীয় মনোনয়ন পেলে জনগণ আমাকে অতীতে যেভাবে সমর্থন করেছে, তাতে আমি নিশ্চিত ধানের শীষের বিজয় কেউ রুখতে পারবে না। আমার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নেই। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যাব। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক পৌর মেয়র মকলেছুর রহমান বাবলু যুগান্তরকে বলেন, দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্রচর্চার জন্য আগে নিরপেক্ষ নির্বাচন দরকার। গণতন্ত্র না থাকলে ভালো কাজ করা কঠিন। আমি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলে সাধারণ মানুষের সমস্যার সমাধানে কাজ করে যাব। এছাড়া ঈশ্বরদী উপজেলা বিএনপি সভাপতি শামসুদ্দিন আহমেদ মালিথা, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টুও মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন। শামসু্িদ্দন মালিথা জনসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। মনোনয়নের দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে জাতীয় পার্টির সাবেক জেলা সভাপতি হায়দার আলী। এ আসনে তিনি দলের একক প্রার্থী। গণসংযোগও শুরু করে দিয়েছেন। জানতে চাইলে হায়দার আলী যুগান্তরকে বলেন, অপরাজনীতির হাত থেকে রেহাই পেতে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আদর্শের জাতীয় পার্টির শাসন দেখতে চায় জনগণ। তিনি বলেন, আশা করছি, আগামী নির্বাচনে ভোটে আমি বিজয়ী হব। এর আগে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিলেন জামায়াতের মাওলানা নাসির উদ্দিন। ২০০১ ও ২০০৮ সালে জোটের স্বার্থে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। জামায়াতের নেতাকর্মীরা বলছেন, তাদের একটি বিশাল ভোটব্যাংক থাকার পরও জোটের স্বার্থে দুইবার আসনটি ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপিকে। এজন্য জামায়াত ও জোটকে মাশুল দিতে হয়েছে। আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসনটি ফিরে পেতে নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় রয়েছেন জামায়াতের সাবেক জেলা সেক্রেটারি আবু তালেব মণ্ডল। অনেকের ধারণা, পাবনা-৪ আসনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি প্রার্থীর মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তবে নির্ভর করছে বিএনপির কোন্দল কোনদিকে মোড় নেয়, তার ওপর।