আ’লীগ-বিএনপিতে একাধিক প্রার্থী মাঠে জাতীয় পার্টি-জামায়াত
মো. মাহফুজ আলম মুনী, নাটোর ও দিল মোহাম্মদ, গুরুদাসপুর
প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলা নিয়ে নাটোর-৪ আসনে নির্বাচনী আবহ বিরাজ করছে। বিভিন্ন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নানা কৌশলে এখন মাঠে। ভোটারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি করছেন গণসংযোগ। মোড়ে মোড়ে সাঁটানো হয়েছে প্রার্থীদের ছবিসংবলিত বিলবোর্ড ও ব্যানার। মোবাইল মেসেজেও চলছে প্রচার। অনেক প্রার্থী ফেসবুকেও সক্রিয়। এলাকার সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতেও থাকার চেষ্টা করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
এ আসনে আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে পুরাতনের সঙ্গে নতুন একাধিক প্রার্থী প্রচারে রয়েছেন। মাঠে সক্রিয় জাতীয় পার্টির একক প্রার্থী। এর আগে এ আসনে এককভাবে কোনো দল রাজত্ব না করলেও নব্বইয়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশির ভাগ সময় এ আসনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। ১৯৯১ সালের ভোটে এমপি হন আওয়ামী লীগের অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস, ১৯৯৬ সালের বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে এমপি হন বিএনপির অধ্যক্ষ একরামুল আলম ও ’৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস, ২০০১ সালে বিএনপির মোজাম্মেল হক এবং ২০০৮ ও ২০১৪ সালে নির্বাচনে এমপি হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস। আগামী নির্বাচনে শক্ত প্রার্থী তিনি। পিতার পক্ষে মাঠে কাজ করছেন অধ্যাপক কুদ্দুসের মেয়ে কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি। তবে পিতার অবর্তমানে মুক্তি এ আসনে নিজেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে গড়ে তুলছেন। যুব মহিলা লীগ নেত্রী আগামী নির্বাচন সামনে রেখে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। যোগ দিচ্ছেন সভা সমাবেশে। দলের জন্য কাজ করার পাশাপাশি নেতাকর্মীদের সুখে দুঃখে তাকে দেখা যায়।
বাবা-মেয়ের সামনে নাটোর-৪ আসনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী এবং গুরুদাসপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র শাহনেওয়াজ আলী মোল্লা। দুই উপজেলার বড়াইগ্রামে ভোটার সংখ্যা বেশি হলেও বরাবরই গুরুদাসপুর থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচনে বড়াইগ্রামে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার জোরালো দাবি নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন ডা. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী। চিকিৎসক হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। এ ছাড়া মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে মাঠে রয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রতন সাহা ও আহাম্মদ আলী মোল্লা। গুরুদাসপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দুইবারের নির্বাচিত পৌর মেয়র শাহনেওয়াজ আলী মোল্লাও মাঠে বেশ সক্রিয়। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমপির নির্দেশে পুলিশ তাদের কেবল লাঠিপেটাই করেনি, তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দিয়ে নেতাকর্মীসহ তাকে আটক করেছিল। ডা. পাটোয়ারী বলেন, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে এমপি আবদুল কুদ্দুস টাকার পাহাড় গড়েছেন। প্রাইমারি স্কুলের নৈশপ্রহরী থেকে শুরু করে স্কুল ও কলেজে অর্থের বিনিময়ে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে পুনর্বাসিত করেছেন। দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করায় দুটি উপজেলা নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। এমনকি বড়াইগ্রামের দুটি ইউপি নির্বাচনেও নৌকার বিপক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নেন এমপি। নৌকার পক্ষে কাজ করা নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। এলাকায় কুদ্দুসবিরোধী অবস্থান তৈরি হয়েছে। তাকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করা হয় কয়েকবার।
মোট চারবারের নির্বাচিত এমপি সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক কুদ্দুস সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, নিয়োগ বা উন্নয়ন কাজে টাকা নেয়ার প্রমাণ কেউই দেখাতে পারবেন না। জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলে তার দাবি। তিনি বলেন, এলাকার সর্বত্রই আমার উন্নয়নের ছোঁয়া। দুটি কলেজ ও একটি হাইস্কুল সরকারি করার পাশাপাশি এলাকার স্কুল-কলেজ, রাস্তা-ঘাট ও ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণসহ নানামুখী উন্নয়নে কোটি কোটি টাকার কাজ হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। আর সে কারণেই সবসময় জনগণ তার পাশে আছে। কিছু নেতাকর্মীর অনৈতিক দাবি পূরণ না করায় তার বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। এভাবে বিরোধিতা করার পরও তিনি বারবার মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন ও বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে তিনি শতভাগ আশাবাদী।
আগামী নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অন্যতম হচ্ছেন সাবেক এমপি অধ্যাপক মোজাম্মেল হক। নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, এমপি হওয়ার আগেই গুরুদাসপুর রোজী মোজাম্মেল মহিলা কলেজ, খুবজীপুর মোজাম্মেল হক কলেজ, আহম্মেদপুর এমএইচ হাইস্কুল এবং চক্ষু হাসাতালের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাসহ এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি শতভাগ নিশ্চিত।
এ ছাড়া গুরুদাসপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল আজিজ মাঠপর্যায়ে ব্যাপক গণসংযোগ চালাচ্ছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় থাকায় মনোনয়নের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।
এ আসনে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট রয়েছেন। মনোনয়ন পেলে বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট জন গমেজ। দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে বড়াইগ্রাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি নাটোর বারের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আবদুল কাদের মিয়া, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হজরত আলী এবং দুই বারের নির্বাচিত সাবেক পৌরমেয়র ও উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ইসাহাক আলীও মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন। তবে এ আসনে স্থানীয়ভাবে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুও প্রার্থী হতে পারেন বলে দলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন। বলছেন, দুলুকে মনোনয়ন দিলে স্থানীয় নেতাদের ঠাণ্ডা লড়াইয়ের নিরসন হবে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, বড়াইগ্রাম-গুরুদাসপুর এলাকার নেতাকর্মীরা চাইলে তিনি বাধ্য হয়েই এ আসন থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, সব দিক বিবেচনা করে তাকে মনোনয়নও দেবে।
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক এমপি আবুল কাশেম সরকার দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। এমপি থাকার সময় তিনি বিভিন্ন উন্নয়নকাজ করেছেন। সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ চমৎকার। তিনি বলেন, রংপুরের বিজয় প্রমাণ করেছে জাতীয় পার্টির অবস্থান কতটা শক্তিশালী। বড় দু’দলের কোন্দলের ফাঁকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়লাভ করবে। এ ছাড়া নিজ দল ছাড়াও মহাজোটের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।
জেলা জামায়াতের সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন খান স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। নাটোর জেলা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মুন্সীকে জেলা সম্মেলনে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেয়ায় তিনি মাঠে নেমে পড়েছেন আগেই। এ ছাড়াও জাসদ (ইনু) জেলা সেক্রেটারি ডিএম আলম ও গত নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রাপ্ত গুরুদাসপুর উপজেলা সভাপতি অধ্যক্ষ মোখলেছুর রহমান এলিন মহাজোটের মনোনয়ন পেতে লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। ন্যাপ নেতা অ্যাডভোকেট হারুন অর রশিদ বুলবুলও মনোনয়নের জন্য মাঠে রয়েছেন।