সুনামগঞ্জ-২: আ’লীগের ঘাঁটিতে প্রার্থীজট নাছিরেই ভরসা বিএনপিতে
আবদুর রশিদ রেনু, সিলেট ব্যুরো, জিয়াউর রহমান লিটন, দিরাই প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
দিরাই ও শাল্লা উপজেলা নিয়ে সুনামগঞ্জ-২ আসনটি মূলত আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। অনেকে আবার এটিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আসন হিসেবেই জানে। এ পর্যন্ত ১০টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৭টিতে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
ভোটে জয়লাভ করার জন্য তার ব্যক্তি ইমেজই বেশি কাজ করেছে অতীতে। তিনি যখন ন্যাপ, একতা, গণতন্ত্রী পার্টি করতেন তখনও তিনি জয়লাভ করেছেন এ আসনে। বিশেষ করে নব্বইয়ের পটপরিবর্তনের পর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি ও ১২ জুনের নির্বাচন বাদে সব কটি নির্বাচনে জয়লাভ করেন সুরঞ্জিত।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির মিফতা উদ্দিন চৌধুরী রুমী এবং ওই বছরের ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির নাছির উদ্দিন চৌধুরী। এ ছাড়া চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জয়লাভ করে জাতীয় পার্টি।
২০০৮ সালের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে ৯৫ হাজার ৫৯৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নাছির চৌধুরী পান ৭৭ হাজার ৮৮৯ ভোট। ২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন ভোটে জয়লাভ করেন তিনি। তার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে জয়ী হন তার স্ত্রী ড. জয়া সেনগুপ্তা। আগামী নির্বাচনেও জয়া সেনগুপ্তা প্রার্থী।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন জয়া সেনগুপ্তা। আওয়ামী লীগের আরও অনেকেই মনোনয়ন চাচ্ছেন। সুরঞ্জিত বিহীন এ আসনে দলের অন্তত হাফ ডজন প্রার্থী মাঠে সক্রিয়। সেদিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে বিএনপি।
দলের জেলা কমিটির সাবেক আহ্বায়ক নাছির উদ্দিন চৌধুরীর দলীয় মনোনয়ন অনেকটা নিশ্চিত বলে জানা গেছে। আগামী নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত জয়া সেনগুপ্তা ও নাছির উদ্দিনের মধ্যে লড়াই হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সুরঞ্জিত বিহীন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়ে দলে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। তবে আগামী নির্বাচনেও সুরঞ্জিত সেনের ব্যক্তি ইমেজ বিশেষভাবে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন তার অনুসারীরা।
এর পরও আওয়ামী লীগ সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক অ্যাডভোকেট সামছুল ইসলাম, শাল্লা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট অবনি মোহন দাস, এমসি কলেজের সাবেক ভিপি ইকবাল হোসেন, ছায়েদ আলী মাহবুব রেজু, কেন্দ্রীয় যুবলীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার অনুকুল তালুকদার ডাল্টন, যুক্তরাজ্য প্রবাসী কমিউনিটি নেতা সামছুল হক চৌধুরী।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট দীপক চৌধুরীর নামও আলোচনায় আছে। তবে আওয়ামী লীগের ৫ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী জয়া সেনের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে মাঠে আছেন। ইতিমধ্যে তারা দিরাই ও শাল্লায় সভা করে দলের প্রার্থী বদলের দাবি জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ- ‘জয়া সেনগুপ্তাকে ঘিরে রেখেছেন দলের সুবিধাভোগী ও অনুপ্রবেশকারীরা, সারা দেশে উন্নয়ন অগ্রগতি হলেও এলাকায় উন্নয়ন থমকে আছে।
কথা হয় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ইকবাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, পরিবর্তনের বিকল্প নেই, দীর্ঘ চল্লিশ বছর দিরাই-শাল্লাকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে, শেখ হাসিনার উন্নয়নকে লুটপাটকারীরা বাধাগ্রস্ত করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এ অবস্থার পরিবর্তন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দিরাই-শাল্লার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে চাই।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায় বলেন, ‘দিরাই-শাল্লার মানুষ সুরঞ্জিতকে ভালোবেসে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মর্যাদার আসনে জায়গা দিয়েছেন, আগামীতেও অমর্যাদা হবে না।
আগামী নির্বাচন হবে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দিরাই-শাল্লার উন্নয়নের পক্ষে ও সুরঞ্জিত সেনের মর্যাদা রক্ষার। আওয়ামী লীগে কোনো বিভক্তি নেই, জয়া সেনগুপ্তার নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত, তৃণমূলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না রেখে কারও প্রার্থিতা দাবি করার যৌক্তিকতা নেই।’
জানতে চাইলে জয়া সেনগুপ্তা বলেন, ‘আমাদের অভিভাবক দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। একাধিক প্রার্থী সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা প্রত্যেকের গণতান্ত্রিক অধিকার।
সুবিধাভোগীদের কারণে ত্যাগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই, ভাবিষ্যতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়েই উন্নয়ন কাজ করতে চাই, আমার স্বামীর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে চাই। আগামী নির্বাচনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ইমেজ ও দলীয় ঐক্য এবং শক্তি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শহীদ পরিবারের সন্তান সিলেট ল’ কলেজ ছাত্র সংসদের ছাত্রলীগের সাবেক ভিপি অ্যাডভোকেট সামছুল ইসলাম। গত উপনির্বাচনের পর থেকে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তৃণমূলে পৌঁছে দিতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তিনি দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে আশাবাদী।
অ্যাডভোকেট অবনি মোহন দাস বলেন, নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করতে হলে তৃণমূলের দাবি নৌকার মাঝি বদল করতে হবে। তিনি দাবি করেন, বর্তমান এমপির সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কেউ নেই। তিনি সুবিধাভোগীদের লালন করছেন, তারা লুটপাট করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছেন।
‘দিরাই-শাল্লার রাজনীতি উন্নয়নের রাজনীতি, হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই নৌকার বিকল্প নাই’- এ স্লোগান নিয়ে এবং সরকারের উন্নয়ন-অগ্রগতির চিত্র পোস্টার-ব্যানার, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তুলে ধরছেন ছায়েদ আলী মাহবুব। তিনি বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নে কাজ করতে চাই, উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হলেও জয়া সেনগুপ্তাকে অভিনন্দন জানিয়েছি।
যুক্তরাজ্য শ্রমিক লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সামছুল হক চৌধুরী বলেন, ছাত্রলীগের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আসি। রাজনীতিতে নিতে নয়, দিতে এসেছি। এলাকার সার্বিক উন্নয়নে নিজেকে নিবেদিত করতে চাই।
এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে এ পর্যন্ত বিএনপি জয়লাভ করতে পারেনি। তবে আওয়ামী লীগে মনোনয়ন নিয়ে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে সেই সুযোগে বিএনপি আসনটি দখলে নিতে মরিয়া। বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন সাবেক এমপি ও সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক নাছির উদ্দিন চৌধুরী।
যুক্তরাজ্য বিএনপির প্রবাসী কমিউনিটি নেতা তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেলের নাম আলোচনায় রয়েছে। জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শেখ মোহাম্মদ জাহির আলী।
জাসদের আমিনুল ইসলাম আমিন, গণতন্ত্রী পার্টির গুলজার আহমদ, খেলাফত মজলিসের মাওলানা নুর উদ্দিন আহমদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাওলানা সোয়াইব আহমদ, ইসলামী আন্দোলনের আবদুল হাই, কমিউনিস্ট পার্টির নিরঞ্জন দাস খোকন, বাসদের আজহারুল ইসলাম চৌধুরী।
বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে কথা হয় দিরাই উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম মিয়ার সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘দলীয় মনোনয়ন নাছির উদ্দিন চৌধুরীই পাচ্ছেন এটা প্রায় নিশ্চিত। তিনি দলের সাংগঠনিক অবস্থানকে চাঙ্গা করার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে যাচ্ছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীরা তাকেই মাঠে পাচ্ছেন। এলাকায় তার ব্যাক্তি ইমেজও ভালো।’
জানতে চাইলে সাবেক এমপি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে জানান, বিএনপি ভোটে এলে আমি নির্বাচন করব। তবে দিরাই-শাল্লায় আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছুই নেই, যারা কোনো কিছুতেই জড়িত নেই তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে কিন্তু ট্রিপল মার্ডারের ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিরা প্রকাশ্যে মিটিং করছে। এলাকায় কোনো উন্নয়নও নেই, রাস্তায় চললে কোমর ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়।’