যুগান্তরকে ইউএপি উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান
স্মার্ট ক্যাম্পাস গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ উচ্চশিক্ষায় ভিড় করে থাকে। এক্ষেত্রে নানা কারণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও থাকে পছন্দের তালিকায়। বিশেষ করে সচ্ছল পরিবারের যেসব সন্তান উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যান না, তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নেন। এছাড়া পছন্দের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় না পাওয়া শিক্ষার্থীরাও এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন। এমন বাস্তবতায় বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব দিনদিন বাংলাদেশে বেড়ে চলেছে। এ নিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে স্বপ্ন, বাস্তবতা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান।
যুগান্তর : বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষার উপযোগিতা ও বাস্তবতা নিয়ে অনেক কথা আছে। ইতোমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান দুর্নাম কামিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ কী?
কামরুল আহসান : বিশ্বের কয়েকটি দেশ শিক্ষা খাতকে বিশেষ করে উচ্চশিক্ষাকে বর্তমানে একটি ইন্ডাস্ট্রিতে (শিল্পখাত) পরিণত করেছে। মালয়েশিয়া ওইসব দেশের একটি। অন্যান্য শিল্প খাত থেকে যেভাবে দেশটি উপার্জন করে, এই খাত থেকেও সেভাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। আমার জানামতে, প্রতিবছর ৬০ হাজার বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় লেখাপড়া করতে যায়। আবার যারা মালয়েশিয়ায় লেখাপড়া করে তারা সেখানে কিন্তু চাকরি করে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায়। কিছু অংশ অবশ্য দেশে ফিরে আসে। তবে বিদেশে যারা পড়তে যায়, তাদের বড় একটি অংশ বিদেশেই চাকরি এবং দেশে ডলার পাঠায়। অর্থাৎ তারা জাতীয় অর্থনীতিতে কোনো না কোনোভাবে অবদান রাখছে। এটাকে যথার্থ অর্থে ব্রেন ড্রেন বা মেধা পাচার বলব কিনা-সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।
যুগান্তর : দেশের উচ্চশিক্ষায় আপনার বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে ভূমিকা রাখছে?
কামরুল আহসান : বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটি ‘ডাইনামিক অ্যান্ড কমপ্লেক্স সিস্টেম’ (গতিশীল ও জটিল ব্যবস্থা)। বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতির দিক বিবেচনা করলে প্রথমেই আসে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এর সঙ্গে চলে আসে লাইব্রেরি-ল্যাবরেটরির উন্নতি। আমাদের বিশ্বমানের ল্যাবরেটরি আছে। ৫২টি উন্নতমানের ক্লাসরুম আছে, যেখানে ব্লেন্ডেড লার্নিং, ফিলিপ লার্নিং, রিমোট লার্নিং সব ব্যবস্থা আছে। অনলাইন বা জুমে ক্লাস করার ব্যবস্থাও আছে। আসলে কোভিডকালীন থেকে যথাসময়েই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু মাস্টার্স ডিগ্রি দিতে পারে। এমফিল-পিএইচডি দিতে পারে না। তাই মাস্টার্স প্রোগ্রামই গবেষণার ক্ষেত্রে অবদান রাখার উপায়। এখানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকি। বিশেষ করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং আর ফার্মাসির ক্ষেত্রে কাজ তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। আমাদের একাধিক জার্নাল আছে।
যুগান্তর : আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পদ্ধতি বিস্তারিত বলুন।
কামরুল আহসান : বর্তমানে ‘আউটকাম বেসড এডুকেশন’-এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। আমরা সেদিকে মনোনিবেশ করেছি। এর সঙ্গে দিকে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। সেটি হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা ‘স্টুডেন্ট লার্নিং সেন্টারে’ পরিণত করেছি। আগে পাঠদান বলতে ছিল-শিক্ষক পড়িয়ে যাবেন, শিক্ষার্থী শুনবে। এখন এটাকে বলছি-‘স্টুডেন্ট বেজড লার্নিং’। এটা হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক (পারটিসিপেটরি) বা অবদানমূলক (কন্ট্রিবিউটিং) শিখন। শুধু শিক্ষক বলবেন না, ক্লাসরুমে লেকচারে শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীও অংশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবেন। এই দর্শন সামনে রেখে আমরা আমাদের কোর্সগুলোকে নতুন করে তৈরিও (ডিজাইন) করছি। প্রয়োজনে চার বছর পরপর ইউজিসি থেকে কোর্স-কারিকুলাম অনুমোদন নেওয়া হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে আমরা (ইউএপি) উন্নতি করছি।
যুগান্তর : বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতি বিশ্বকে আর্থিকভাবে ওলটপালট করে গেছে। এমন বাস্তবতায় আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব কী কর্মসূচি আছে?
কামরুল আহসান : কোভিড-১৯ মহামারির বাস্তবতায় সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীরাই আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এছাড়া সামনে একটা আর্থিক মন্দার পূর্বাভাসও আছে। প্রথমত, এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় আইনেই নির্দেশিত পন্থা আছে। ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বিনা পয়সায় পড়াতে হবে। এর মধ্যে ৩ শতাংশ থাকবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা তার উত্তরাধিকারীরা। বাকিটা দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া পরিবারের সন্তান। আমরা এদিকে নজর দিতে গিয়ে প্রায় ১০ শতাংশকে এমন সুবিধা দিচ্ছি। এছাড়া করোনাকালীন প্রায় ২৫ শতাংশ টিউশন ফি মওকুফ করেছি।
যুগান্তর : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে ইউএপি কী ভূমিকা পালন করে?
কামরুল আহসান : প্রথম কথা হচ্ছে, কর্মজীবনে প্রবেশে ইন্ডাস্ট্রি আর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা সংযোগ বাড়াচ্ছি। বিপরীতদিকে ইন্ডাস্ট্রিকে তাদের সিএসআর (করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটিজ) শেয়ার করার অনুরোধ করি। মূল কথা হচ্ছে, ছাত্রদের সঙ্গে তাদের মিথস্ক্রিয়া বাড়িয়ে দেওয়া দরকার। লেখাপড়া শেষে একটা ছাত্র যখন কোথাও চাকরির জন্য যায়, তখন সে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে সেখানে পরিচিত হয়।
যুগান্তর : বর্তমানে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়টি অনুষদ, বিভাগ এবং ইনস্টিটিউট রয়েছে। বর্তমানে আপনাদের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক সংখ্যার অনুপাত কত?
কামরুল আহসান : ইউএপিকে একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলেই গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে অনুষদ আছে ৭টি। এসব অনুষদের অধীনে মোট বিভাগ আছে ৯টি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ২০:১। ৫৩৬৮ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক ২৬৭ জন। বর্তমানে আমাদের একটিই স্থায়ী ক্যাম্পাস আছে, যেটা এই ফার্মগেটে অবস্থিত। এক একর (তিন বিঘা) জায়গায় ২০১৫ সাল থেকে আমাদের নিজস্ব এই ক্যাম্পাসে একাডেমিক এবং সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এছাড়া ঢাকার পূর্বাচলে আমাদের ৮ বিঘার জমি আছে যা এখন হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। সপ্তম প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইতোমধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী সনদ পেয়েছি।
যুগান্তর : আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
কামরুল আহসান : এক্ষেত্রে স্বল্প ও দীর্ঘ দুই মেয়াদি শিক্ষণ পরিকল্পনা আমাদের আছে। দীর্ঘমেয়াদে চাহিদা নিরূপণ করে কিছু কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। পাশাপাশি পাঠ্যক্রম বদলে ফেলতে হবে। আর স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রকৌশল, ব্যবসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া।
যুগান্তর : সুনাম আর সম্মানের সঙ্গে বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষা কীভাবে এগিয়ে যেতে পারে?
কামরুল আহসান : কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে দুর্নামের ভাগ যে নিতে হচ্ছে সেটা সঠিক। আবার এটাও ঠিক যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। প্রতিযোগিতা থাকা ভালো। এতে উত্তরোত্তর ভালো করার প্রচেষ্টা থাকে। নইলে আমরা আগাতে পারব না। তবে এ ক্ষেত্রে জরুরি হচ্ছে সক্ষমতা। যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই, ম্যাচিং ফান্ড গঠন, কোলাবরেটিভ প্রোগ্রাম চালু, শিক্ষার্থী এক্সচেঞ্জ এমন নানা পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।