নতুন পথে নতুন চ্যালেঞ্জ
শাহ আলম খান
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০১৮, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাতারে বাংলাদেশের বহুল প্রতীক্ষিত পথচলা শুরু হয়ে গেছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বের হওয়ার জন্য জাতিসংঘ কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (ইউএনসিডিপি) নির্ধারিত সব মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে চলতি সপ্তায় শেষ হওয়া সংস্থাটির পাঁচ দিনব্যাপী ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়নের প্রাথমিক ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশের নতুন বিশ্বের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং সীমাহীন সম্ভাবনার খোঁজে কঠিনতর যাত্রা।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে যাত্রাটি খুব আনন্দের। অন্যদিকে চ্যালেঞ্জেরও। কারণ বাংলাদেশের জন্য নতুন পথে এ পথচলাটি শুধুই পরীক্ষামূলক। এ পর্যায়ে বাংলাদেশের সামনে নতুন নতুন অনেক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আসবে। আর তা মোকাবেলায় কতটা সক্ষম এজন্য আরও ৬ বছর তার প্রমাণ দিতে হবে। এ কঠিন চ্যালেঞ্জের মূল বার্তা হচ্ছে- ভবিষ্যতে কারও দয়ায় বাংলাদেশকে আর চলতে দেয়া হবে না। জোট-সংস্থা বা দাতাদের প্রণোদনার ওপরও ভর করা যাবে না। অর্থাৎ চলমান অর্থনৈতিক কাঠামোকে পুঁজি করে নিজস্ব সক্ষমতার ওপরই এগোতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যুগান্তরকে বলেন, এলডিসি উত্তরণের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা ও শঙ্কা দু’টোই রয়েছে। তবে সতর্ক থাকলে সম্ভাবনার পাল্লাই ভারি হবে। কতটা সম্ভব সেটা দেখতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে সম্ভাবনার জায়গাটি হচ্ছে সামনে সাম্প্রতিক উন্নয়ন ইতিহাসে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ এক অনন্য ঘটনা। কারণ যেসব দেশ এর আগে এলডিসি থেকে বের হয়েছে, তারা ছিল খুব ছোট দেশ। তাদের জনসংখ্যা কম ছিল। উৎপাদনের পরিমাণ কম ছিল। এর তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বিস্তৃত। তাই চ্যালেঞ্জ থাকলেও সম্ভাবনাও সীমাহীন। সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এলডিসি উত্তরণের ঘটনা এমন সন্ধিক্ষণের মধ্যে রয়েছে- যখন অর্থনীতির একাধিক উত্তরণ প্রক্রিয়া একসঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে আছে, স্বল্প আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্য আয়ের দেশে পা রাখা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন, মধ্য আয়ের দেশ অতিক্রম এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে যাত্রা। একটা সূচকের সঙ্গে আরেকটা সূচক পারস্পরিক নির্ভরশীল বলে- এলডিসি উত্তরণের ঘটনা অর্থনীতিতে একটা নতুন সুযোগের সৃষ্টি করে দেবে।
জাতিসংঘের শর্তানুযায়ী, কোনো দেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে হলে পরপর তিন বছর মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই) ১২৪২ ডলার হতে হবে। বাংলাদেশের আছে ১৬১০ ডলার। মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে ১০০-এর মধ্যে ৬৬ বা তার বেশি অর্জন করতে হয়, বাংলাদেশের অবস্থান ৭২.৯ ভাগে। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ বা তার নিচে থাকার শর্ত রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান ২৫.০৩-এ। বাংলাদেশকে অবশ্য সূচকের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে ২০২১ সাল পর্যন্ত; যা নানা হিসাব-নিকাশের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত উত্তরণ ঘটবে ২০২৪ সালে। তবে উত্তরণের পথে বাংলাদেশের সুবিধা হল হারানোর আশঙ্কা রয়েছে এমন সুবিধাগুলো ২০২৭ পর্যন্ত চলমান থাকবে।
সিপিডির এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই উত্তরণের পর দেখা গেছে, প্রবৃদ্ধিতে পতন ঘটেছে। বৈদেশিক সাহায্য এবং রেমিটেন্সের পতন ঘটে। এর ফলে তাদের যে আর্থিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে তার ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে কর আদায়ের পরিমাণ না বাড়লে এ সমস্যা আরও জোরালো হয়। এর বিপরীতে এ সময়ে দেশগুলো বিশ্বের অনেক নতুন বিনিয়োগ পেয়েছে। তবে এ প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফল হবে কি-না সেটিই এখন দেখার বিষয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশ যে প্রক্রিয়াকরণ খাতকে (রফতানি) গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং তার রফতানি বাড়ছে। কিন্তু সেখানে একটি খাতের ওপরই (তৈরি পোশাক) নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে। অপরদিকে এ খাতে শ্রমের উৎপাদনশীলতা ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া আগে যে রেয়াতি সুদে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যেত সেখান থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে যাবে। এর ফলে বাংলাদেশকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হবে। এ প্রক্রিয়ার সঠিক সমন্বয় না হলে অভ্যন্তরীণ অর্থ ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়তে পারে। সিপিডির মতে, সবচেয়ে শঙ্কার পরিস্থিতি তৈরি হবে রফতানি খাতে। যেসব বাজার বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় এলডিসি উত্তরণের পর তা আর থাকবে না। এতে রফতানি প্রতি ১০০ টাকায় আগের চেয়ে সাড়ে ৭ টাকা বেশি দিতে হবে। ফলে তখন প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উৎপাদনশীলতা বাড়ানো একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া আবহাওয়াগত বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে আছে বিশ্ব। সেগুলোকে মোকাবেলা করার বিষয় উঠবে। পাশাপাশি যেসব সুবিধা ধরা দিতে পারে সেগুলো হচ্ছে- ১. উদ্যোক্তার মধ্যে সৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব। এর ফলে দেশে ছোট-বড় লক্ষাধিক উদ্যোক্তার মধ্যে সনাতনী চেতনার পরিবর্তন ঘটবে এবং সেটি বিশ্বায়নের ঝুঁকি মোকাবেলায় নিরাপদ ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। এ মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের প্রভাব মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) গতি সঞ্চার করবে। ২. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। ইতিবাচক ভাবমূর্তি বিশ্বের যে কোনো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায়। ৩. বিশ্বায়নের অবাধ প্রতিযোগিতায় উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটবে। এর কারণ উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশের আগে হাতে থাকা ৯ বছর সময়ে বাংলাদেশের শিল্পপণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য আসবে।