
প্রিন্ট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১২ এএম
আমলা ও বঙ্গবন্ধু

বিমল সরকার
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
রাষ্ট্র যা দ্বারা পরিচালিত হয় সংক্ষেপে তাকেই বলে রাষ্ট্রযন্ত্র। রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি আমলাশ্রেণি।
একটি সৎ, দক্ষ, নির্মোহ-নিরপেক্ষ ও হৃদয়বান আমলাশ্রেণি দেশবাসীর দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা। সত্যিকারের রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের মনে দেশ পুনর্গঠন ও শাসন পরিচালনায় অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মতোই আমলাশ্রেণি নিয়ে একটি ভাবনা থাকেই।
কারণ দেশ বা জাতির উন্নতি-উন্নয়ন ও সুখ-দুঃখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে প্রধানত তারাই ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ নিয়ে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও ভাবনার অন্ত ছিল না।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয়। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত মহাত্মা গান্ধী নিজে যেমন সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, স্বাধীন দেশের নেতারা এবং সরকারি কর্মচারীদের জন্যও এমন একটি রূপকল্প তৈরি করেছিলেন তিনি স্বাধীনতা লাভ হতে না হতেই।
তিনি ধরে নিয়েছিলেন, ‘স্বাধীন ভারতের কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ নিজের হাতে করবেন।
এমনকি তার স্নান-পায়খানার ঘরটি তিনি নিজের হাতে পরিষ্কার করতেও কুণ্ঠাবোধ করবেন না।’ আর এভাবেই ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ও পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস, এমনকি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেও একথাটি প্রচলিত আছে যে কর্মীদের ‘জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ পর্যন্ত’ সবকিছু জানতে ও নিজের হাতে করতে হয়।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ৭ ও ৮ এপ্রিল (শুক্র ও শনিবার) ১৯৭২।
উদ্বোধনী বক্তৃতায় দল ও সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্য অনেকের উদ্দেশে যেমন, ঠিক তেমনি ভাষায় সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘সরকারি কর্মচারিরা যদি জনস্বার্থের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে না পারেন তাহলে প্রয়োজনবোধে খোল নইচা সবই বদল করা হবে।’
একইভাবে ও ভাষায় বঙ্গবন্ধু দলীয় কর্মীদেরও যখন-তখন অফিসারদের কাছে ঘোরাঘুরি না করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এক হাতে তালি বাজে না’ (সূত্র : দৈনিক আজাদ, পৃষ্ঠা- ১, তারিখ ৮ এপ্রিল ১৯৭২)।
দেশের মানুষের অবস্থা ও মনোভাব এবং তাদের প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ এবং অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুর অনেক হয়েছিল। ইংরেজ আমলের শেষদিকটা এবং পাকিস্তান আমলের পুরোটাই তিনি খুব কাছে থেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন। সাদা বর্ণের ইংরেজ আমলারা তো এদেশের সাধারণ জনগণকে মানুষ বলেই গণ্য করতে চাইত না।
ওদের আচরণ সম্পর্কে ভুখা-নাঙ্গা হতভাগ্যদের নিয়ে কত ঘটনা ও কাহিনী প্রচলিত আছে। ওইসব ‘সাহেব-সাদা আদমি-দুরাচারীদের’ কথা সহজে ভুলে যাওয়ার নয়।
১৮৩৩ সালে সদম্ভে উচ্চারণ করা লর্ড মেকলের বিখ্যাত উক্তিটিই কি তাহলে সত্যি বলে প্রমাণিত হল? এদেশে ইংরেজি শিক্ষার উদ্দেশ সম্পর্কে মেকলে বলেছিলেন, ‘এদেশে এমন একটি শ্রেণী বানাতে হবে, যার বর্ণ ও রক্ত ভারতীয়দের; কিন্তু রুচি, অভিমত, নীতিবোধ এবং বুদ্ধিশীলতা ইংরেজের।’ উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ (১৮৭০-১৯২৫) এ ব্যাপারে চমৎকার বলেছেন।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংরেজদের পাশাপাশি শিক্ষিত ভারতীয়রা সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতে শুরু করলেও জনসাধারণের প্রতি সিভিলিয়ানদের মনোভাবের খুব একটা পরিবর্তন না হওয়ায় তিনি খেদমিশ্রিত ভাষায় উচ্চারণ করেন, ‘আমরা সাদার পরিবর্তে কালোর আমলাতন্ত্র চাই না (মহৎপ্রাণ ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র ছিলেন)।’
একটি কথা দিবালোকের মতোই সত্য, স্বাধীনতার পর সাধারণ প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশায় যিনি যেখানে নিয়োজিত রয়েছেন সবারই মূল ঠিকানাটি এদেশের ধুলো-কাদা-মাটিতেই প্রোথিত। তারা সবাই কারও না কারও সন্তান, ভাইবোন অথবা কাছের-দূরের কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কযুক্ত।
সাত সমুদ্র-তেরো নদী কিংবা পঞ্চনদীর ওপার থেকে কেউই আসেননি। নিকটজন মনে করে অধিকার ও দাবি খাটিয়েই বোধ করি বঙ্গবন্ধু বিরাজমান উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার দেয়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে ইয়াহিয়া-টিক্কা খানদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে খুবই দৃঢ়তা ও আস্থার সঙ্গে বলতে পেরেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি- আমি যা বলি তা মানতে হবে ...।’
সরকারি কর্মচারীদের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা-আস্থা-বিশ্বাস আমৃত্যু বজায় ছিল। তাদের বিশ্বাসও কম করেননি, আবার কখনও ছেড়ে দিয়েও তিনি কথা বলেননি।
ঘাতকদের হাতে প্রাণনাশের অল্প কিছুদিন আগে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর দেয়া একটি বক্তৃতায় আমলাদের দায়িত্ব-কর্তব্য, এমনকি নীতিবোধ ও মানবিকতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন-
‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মায়না দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মায়না দেয় ওই গরিব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ওই টাকায়, আমি গাড়ি চড়ি ওই টাকায়, ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন। ... সরকারি কর্মচারীদের বলব, মনে রেখো, এ ব্রিটিশ কলোনি নয়, পাকিস্তানি কলোনি নয়। যে লোককে দেখবা তার চেহারাটা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতো। ওরাই সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজে কামাই করে খায়, তোমরা কাজ করে।
আপনাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা- শিক্ষিত ভাইয়েরা, আপনার লেখাপড়ার খরচ দিয়েছে শুধু আপনার সংসার দেখার জন্য নয়, আপনার ছেলেমেয়ে দেখার জন্য নয়।
দিয়েছে তাদের আপনি কাজ করবেন, সেবা করবেন। তাদের আপনি কী দিয়েছেন, কতটুকু দিয়েছেন; কী ফেরত দিচ্ছেন, কতটুকু দিচ্ছেন? কার টাকায় ইঞ্জিনিয়ার সাব, কার টাকায় ডাক্তার সাব, কার টাকায় অফিসার সাব, কার টাকায় রাজনীতিবিদ সাব, কার টাকায় মেম্বার সাব, কার টাকায় সব সাব?
সমাজ যেন ঘুণে ধরে গেছে। এ সমাজকে আমি চরম আঘাত করতে চাই। এই আঘাত করতে চাই, যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের- সেই আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থাকে।’
হয়নি। স্বাধীনতা লাভের ৪৮ বছরেও একটি সুদক্ষ, বিশ্বস্ত ও হৃদয়বান রাষ্ট্রীয় কর্মীবাহিনী আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। সাবেক সিএসএসপি বা ইপিসিএস সদস্যদের কর্মদক্ষতার কথা আমাদের মনে এখনও ঘুরপাক খায়।
রুহুল কুদ্দুস, কাজী ফজলুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমদ, আলী ইমাম মজুমদার, আইয়ূবুর রহমান, সা’দত হোসাইন, মোফাজ্জল করিমদের মতো ব্যক্তিদের কর্মক্ষেত্র থেকে একে একে বিদায় হওয়ায় মনে হয় জনসাধারণের মনের আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসার জায়গাটি দিন দিন কেবল সংকোচিত হয়ে যাচ্ছে। জাতীয় স্বার্থেই বিষয়টির প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করা দরকার।