‘উন্নয়ন বিস্ময়ের’ অন্তরালে

ড. শামসুল আলম
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পরিকল্পনার দুটি দিক, একটা hardware aspect বা কঠিন দিক যেমন রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, ব্রিজ, কালভার্ট, ভবন ইত্যাদি নির্মাণ পরিকল্পনা। আরেকটা দিক থাকে software aspect বা কোমল দিক, সেটা হলো দারিদ্র্য কমিয়ে আনা, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা বা কতটুকু থাকবে তা নির্ধারণ করা, কর্মসংস্থান কী হবে সেটি নির্ধারণ করা। সব মিলিয়ে একটি পরিকল্পনা অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত বিবর্তনের শক্তিশালী মাধ্যম যা আমরা সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি সন্নিবেশের মাধ্যমে প্রণয়ন করে থাকি। পরিকল্পনা একটি সামগ্রিক লক্ষ্য/অভীষ্টভিত্তিক যোজনা বা সামগ্রিক বাস্তবায়নযোগ্য কর্মসূচি। যার মাধ্যমে দেশ রূপান্তর প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যায়। এবং এর মাধ্যমে আমাদের জীবন মানের উন্নতি সাধন হয়ে থাকে। আমরা ক্রমান্বয়ে একটা উন্নত সমাজব্যবস্থার দিকে ধাবিত হতে থাকি এবং দেশজ সুপরিকল্পনা দেশের দ্রুত অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে। ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন ক্ষমতাসীন হন, তিনি পাঁচসালা পরিকল্পনায় ফিরে আসেন। পরিকল্পনায় ফিরে আসার অর্থ হলো বাংলাদেশে আগে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা ছিল না। প্রথমবারের মতো একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য তিনি নির্দেশনা প্রদান করেন এবং তিনি তার সে রূপকাঠামো নির্বাচনকালীন ইস্তেহারে প্রচার করেছিলেন রূপকল্প ২০২০-২১ নামে, যা ছিল বাংলাদেশের প্রথম দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা (Perspective Plan)-এর ভিত্তি। সে পরিকল্পনায় আমি যুক্ত হয়েছি ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এবং এর মাধ্যমে তিনি পাঁচশালা পরিকল্পনায় ফিরে যান এবং সামনে রাখেন রূপকল্প ২০২০-২১, যেখানে বলা হয়েছে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হব, যেখানে বলা হয়েছে ২০১৫-এর মধ্যে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করব, যেখানে বলা হয়েছে ২০১৩-১৪ সালে আমরা চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ হব, আমরা ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করব ২০২১-এর মধ্যে; করেছি ২৫০০০ মেগাওয়াট, লক্ষ্যমাত্রার বেশি অর্জন করেছি। যেগুলো মূল লক্ষ্য অভীষ্ট আমরা স্থির করেছিলাম ২০১০-২১ এ প্রথম দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায়। এর মাধ্যমে দুটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে, প্রথমটি হলো ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০১০-২০১৫, আরেকটি হলো জুলাই ২০১৬-জুন ২০২০ সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছে এ দুই পরিকল্পনাকালে। এর মূল কারণ, দেশ সুসমন্বিতভাবে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়েছে। এখানে স্মরণ করা যায় ২০০২ থেকে ২০০৯-১০ দেশে কোন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল না। যা ছিল আমাদের সংবিধানের ১৫(গ) ধারার বিচ্যুতি। পবিত্র সংবিধানের এ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে-দেশ ‘পরিকল্পিত উন্নয়নের পথ’ অনুসরণ করবে যাতে প্রত্যেক নাগরিকে পাঁচটি মৌলিক অধিকার (খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান) সুনিশ্চিত করা যায়। দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছিল ১৯৭৩/৭৪-১৯৭৭-৭৮ এ পাঁচ বছরকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরার পর পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিয়ে অত্যন্ত স্বল্প সময়ে ২১ দিনের মাথায় তিনি একটি শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন এ দেশে গড়ে তুলেন। ভারতবর্ষে পরিকল্পনা কমিশন হয়েছিল জাতীয় বীর জওহরলাল নেহরুর সময়ই ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে, স্বাধীনতার প্রায় তিন বছর পর। পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশন হয়েছিল ১৯৫৩ সালে তাদের স্বাধীনতার ৬ বছর পর। সে ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুই প্রথম পরিকল্পনা মাফিক দেশকে এগিয়ে নিতে সংকল্পবদ্ধ হন; তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবেন, তার স্বপ্ন দুঃখি মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন। সেই প্রতীতিতেই তিনি পরিকল্পনার ধারক এবং অনুসারী ছিলেন এবং সে কারণেই ২১ দিনের মাথায় বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেছিলেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পুনর্বাসনকে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং খাদ্য উৎপাদনের জন্য সবুজ বিপ্লবের একটা ভিত্তি তৈরি করা। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার, কূটিল চক্রান্তে শহিদ হওয়ার পর গণমুখী সে পরিকল্পনাটি আর বাস্তবায়িত হতে পারেনি। যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল ১ জুলাই ১৯৭৪ এবং ১৯৭৪-৭৫ প্রথম বছরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল প্রথমবারের মতো ৯.৫ শতাংশ। তারপর ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্ত ঘটনার পর পরিকল্পনাটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষণা করা না হলেও কিন্তু এটি আর বাস্তবায়ন তেমন হয়নি, কারণ রাষ্ট্রীয় আদর্শের একটা বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে যায়। একটি কল্যাণভিত্তিক রাষ্ট্র, জনগণকে শোষণমুক্ত করার যে উৎপাদন প্রক্রিয়া, সেটিকে জোরদার করার জন্য যে উন্নয়ন পরিকল্পনা সেটি আর বাস্তবায়ন হলো না। তার পরিবর্তে আমরা দেখতে পেলাম সামরিক শাসন, রাজনৈতিক উত্থান-পতন। ১৯৮১-৮৫ দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হলো। ১৯৮৬-১৯৯০ তৃতীয় পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণীত হলো। আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক সে সময় (আশির দশকে) একটি কর্মসূচি দেয় যেটাকে বলা হয় ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট’ বা কাঠামোগত সমন্বয়। অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিকাশে যাবতীয় পরামর্শ সেটিতে ছিল। উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়করণ ভণ্ডুল করে দেওয়া। সে সময় সরকারে অভ্যুত্থান শঙ্কা, অস্থিরতা, রাজনীতিকে সংহত করা, সেনাবাহিনীর ছাউনি থেকে রাজনীতিকে গড়ে তোলা ইত্যাদিতে সময় গেছে ১৪ বছর এবং গণতন্ত্রের আন্দোলনে সংগ্রামে দ্বিতীয় দশক চলে যায়। পরিকল্পনাগুলো খুব একটা বাস্তবায়িত হয়নি সে অর্থে, কারণ সরকার ওই স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্টের কথাগুলোই শুনতে চেয়েছেন। বি-রাষ্ট্রীয়করণ করেছেন সে পরামর্শ অনুযায়ী। তারপর ৯০ দশকে এলো আবার বিশ্বব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ব্যংকের নতুন ধারণা, সেটা হলো ‘ওশিংটন কন্সেসাস’। ওয়াশিংটন কন্সেসাসের মূল ধারণাটা হলো ব্যক্তি খাতের বিকাশ, বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং অবাধ বাজারমুখিতা সৃষ্টি এবং অভ্যন্তরীণ যে উৎপাদন ব্যবস্থা এটাকে যতটা সম্ভব বাজারমুখী করা। ‘ওয়াশিংটন কন্সেসার’-এর ভাবধারায় প্রণীত হয়েছিল ১৯৯১-৯৫ চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। সেটিও খুব একটা বাস্তবায়ন হয়েছে তা বলা যায় না, এর প্রমাণ হলো পরিকল্পনা ছিল ১৯৯১-১৯৯৫ মেয়াদে এবং ১৯৯৫ সালে সেটি প্রকাশিত হয়, তার বাস্তবায়ন কখন হবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রথমবারের মতো ২৩ জুন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করলেন অনেকটা নিজস্ব অর্থনৈতিক ধ্যান-ধারণা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং সামাজিক নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়ে। পরিকল্পনাটি প্রণীত হলো ১৯৯৭-২০০২ সময়ের জন্য। সেই পরিকল্পনার সময় ১৯৯৭-৯৮ বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। যদিও ১৯৯৮ সালে প্রবল দীর্ঘমেয়াদি একটা বন্যাও হয়েছিল। সেই পাঁচ বছরেই মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে কম ছিল। নিশ্চিত করা হয় মুঠোফোনের প্রতিযোগিতা। ২০০২/০৩-২০০৯/১০ বাংলাদেশে কোন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল না। কারণ ওয়ার্ল্ডব্যাংক একবিংশ শতকের প্রথম দশকে একটি ধারণাপত্র নিয়ে আসে, সেটা হলো poverty reduction strategy paper, সেটা কোনো পরিকল্পনা ছিল না। পেপার এবং প্ল্যান-এ সমুদ্রের ব্যবধান, কারণ একটা প্ল্যান এ লক্ষ্যমাত্রা থাকে সুনির্দিষ্ট ৫ বছর বা ২০ বছর যেটাই বলবেন, কৌশল থাকে, কর্মসূচি প্রণীত থাকে এবং তদনুযায়ী বরাদ্দ থাকে। সে সময়ের সরকার পিআর, এসপির পথে এগুলো। পিআর, এসপিতে বলা হয়নি, প্রবৃদ্ধির হার কত হবে, যেহেতু সেটা কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ২০০২ থেকে আমাদের কোনো পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল না, যা ছিল আমাদের সংবিধানের ব্যত্যয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ‘১৫-এর গ’-তে বলা হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে পরিকল্পনা মাফিক। ‘প্ল্যানড পাথ অফ গ্রোথ’ ফলো করবে রাষ্ট্র। যাই হোক স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট/কাঠামোগত সমন্বয়, ওয়াশিংটন ঐকমত্য এবং পরবর্তীকালে পিআরএসপি ইত্যাকার বাইরের নানা রকমের কর্মসূচি, প্রেরণা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রেসক্রিপশন আমরা পেয়েছি উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে। ২০০৭-২০০৮-এর অর্থনৈতিক বিশ্বমন্দা প্রমাণ করে কথিত ওইসব উন্নয়ন প্রেসক্রিপশনগুলো ব্যর্থ। ২০০৯-এর পর দেশজ পরিকল্পনা প্রথমে তৈরি হলো ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট’, ‘ওয়াশিংটন কন্সেসাস’ এবং ‘পিআরএসপি’ এগুলোর বাইরে গিয়ে। পিআরএসপি বাংলাদেশ গ্রহণ করেছিল, ভারত পিআরএসপি গ্রহণ করেনি, নেপাল করেনি, আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ করেছিল। যাই হোক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০০৯-তে যখন ক্ষমতায় আসেন এসব বিদেশি প্রেসক্রিপশন, বিদেশি উন্নয়ন ভাবধারা বাদ দিয়ে একটি স্বপ্ন দলিল তৈরি করলেন ২০২০-২০২১ রূপকল্প ধারণ করে। এর ভিত্তিতে প্রথম দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নে আমি নেতৃত্ব দিয়েছি এবং তার অধীনে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন কালেই আমরা ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করি যেটি বাংলাদেশে ৬ শতাংশের ওপরে কোনোদিন যায়নি। প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ-৬ শতাংশের মধ্যে অনেক দিন আটকে ছিল। আমরা বলেছি আমাদের রূপকল্প দলিলে, বাংলাদেশ জন্মজয়ন্তীতে বা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২০০০ ডলারে নিয়ে যাব। এটা ছিল ২০১০-এর প্রক্ষেপণ। এ ২০২১-এ এসে এখন আমাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় ২৫৫৪ ডলার, যেটা ভারতের চেয়েও বেশি, পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। এই যে বৈপ্লবিক এবং বিশাল পরিবর্তন এটা হয়েছে, মূল কারণ হলো দেশ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সুন্দর পরিকল্পনা মাফিক এগিয়েছে। একটা হলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ২০১০-২১, তা বাস্তবায়নে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুধু তাই নয়, ২০২১-এর আগেই ২০৪১ পর্যন্ত দ্বিতীয় একটি স্বপ্ন দলিল তৈরি হলো, যেখানে আমরা সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন ও পথচিত্র তৈরি করেছি। স্বপ্ন নয় চিত্রিত করেছি, প্রত্যেক বছর কত প্রবৃদ্ধি হবে, কর্ম সংস্থান হবে, দারিদ্র্য কত কমবে, শিক্ষার হার কত বাড়বে, প্রত্যাশিত গড় আয়ু কত হবে, আমাদের এ দলিলগুলো পড়লে আপনারা আমাদের এ সুনির্দিষ্ট কর্মসূচিগুলো দেখতে পাবেন ২০৪১ পর্যন্ত। শুধু তাই নয় একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ একমাত্র একটি দেশ যার ১০০ বছরের একটি পরিকল্পনা আছে। কেন ১০০ বছর? জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি স্বল্পমেয়াদি নয়, এটা দীর্ঘমেয়াদে অনুভূত হয়, কাজেই দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রয়োজন হয় এটাকে মোকাবিলা করতে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টাকেও গুরুত্ব দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এবং তার চাহিদা মোতাবেক সাড়ে চার বছর পরিশ্রম করে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ তৈরি করি। আমাদের দ্বিতীয় স্বপ্ন দলিলে বলেছি মানুষের মাথাপিছু আয় হবে ১২,৫০০ মার্কিন ডলার এখনকার বাজারদরে, তখন হবে ১৬,৫০০ মার্কিন ডলার। ২০৪১-এর পর দারিদ্র্য হবে ইতিহাসের পাঠ্য বিষয়। ছেলে মেয়েরা পড়বে আমাদের দেশ একদিন দরিদ্র ছিল। মানুষ খেতে পেত না। দারিদ্র্য থাকবে না, নিরক্ষরতা থাকবে না, কর্মহীনতা থাকবে না, এভাবে দীর্ঘমেয়াদি দ্বিতীয় পরিকল্পনা সাজিয়েছি। প্রতিবছর প্রবৃদ্ধির হার কী হবে, ২০৩০-৩১ এ আমরা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হব। মাথাপিছু আয় হবে ৫৪০০ ডলার। ২০৩০-এর মধ্যে হতদারিদ্র্য মুক্ত হব। এ ভাবে প্রতিটি আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে, ভৌত অবকাঠামোর ক্ষেত্রে আমাদের পুরো স্বপ্ন আবিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা আছে। কাজেই দেশ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে এবং আমরা এ পর্যন্ত ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছি। যে দেশকে বলা হয়েছিল ‘বাস্কেট কেইজ’ সেটা আজ ‘উদ্বৃত্ত ভান্ডার’। বিশ্বখ্যাত পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস এবং অন্যান্য পত্রিকা বলছে বাংলাদেশ ‘ডেভলপমেন্ট মিরাক্যাল’। যদিও আমি মিরাক্যাল বলব না। আমাদের (ক) অতি কর্মক্ষম জনসংখ্যা ছিল এবং (খ) প্রণীত হয়েছে সুন্দর পরিকল্পনা। প্রথমটা ছিল উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শর্ত, আর দ্বিতীয়টা হল উন্নয়নের পর্যাপ্ত শর্ত। এ দুইটা মিলে ম্যাজিকের মতো উন্নয়ন আমরা অর্জন করেছি। ম্যাজিক বলছি কেন? বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রথম শর্তটি সব সময়ই ছিল, দ্বিতীয় শর্তটি কার্যকরভাবে ছিল না বলে প্রবৃদ্ধি তেমন বৃদ্ধি পায়নি। ২০২১-এ এসে ১৩ বছরে আমরা মাথাপিছু আয় বাড়াতে পেরেছি আড়াইগুণ। ২০০৯-এর মাথাপিছু আয় ৯০০ থেকে ২৫৫৪ মার্কিন ডলার বর্তমানে। এর আগে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করতে লেগেছে ২৪ বছর। সে জন্যই বলেছি বাংলাদেশের একটা বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে। উন্নয়ন সহযোগী ঋণ সংস্থাগুলোর প্রভাব বিযুক্ত হয়ে আমাদের ২০০৯ সালের পর প্রণীত সবগুলো পরিকল্পনাকে আমরা কেন ‘নয়া জাতীয় পরিকল্পনার যুগ’ বলি নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারবেন। আমরা চাই, শুধু জাতীয় পরিকল্পনা না এখন আঞ্চলিক পরিকল্পনা প্রয়োজন, প্রত্যেকটি উপজেলায় একটি পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন, প্রতিটি গ্রাম এখন পরিকল্পিতভাবে সাজানো দরকার। এখন আর আমরা এটা অবহেলা করতে পারি না। প্রত্যেকটি নগর হবে পরিকল্পিত। আমরা শহরায়নকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছি, প্ল্যানড আরবানাইজেশন, এ এলোপাতাড়ি গড়ে ওঠা নয়। ২০৫০ এর পর ৮০ শতাংশ লোক শহরবাসী হবে। এখন আমরা যে শহর বুঝি, ২০৪১-এর পরে শহর গ্রামের পার্থক্য তেমন থাকবে না। তারপরও এ লক্ষ্যে একমাত্র পরিকল্পনাই দেশকে সুন্দরভাবে সাজাতে পারে এবং আগামীতে যে স্বপ্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেখেছেন, চিহ্নিত করেছেন তা অর্জনে পরিকল্পনা একটা বড় রকমের ভূমিকা রয়েছে। এ কেবল ভৌত পরিকল্পনা নয়, কেবল শহর বানানো নয়, কেবল বিল্ডিং বানানো নয়, রাস্তাঘাট নয় সেই সঙ্গে শিক্ষার হার বাড়ানো, সেই সঙ্গে দারিদ্র্য নিশ্চিহ্ন করা, শিক্ষার মান উন্নীত করা, সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, বৈষম্য বৃদ্ধি রুখে দেওয়া, সে সঙ্গে আমাদের মূল্যবোধের পরিবর্তন। এ বিষয়গুলোকে আমি বলেছি পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ কোমল অংশ। সেই লক্ষ্যেই আমাদের ভৌত পরিকল্পনা, আঞ্চলিক পরিকল্পনা বা স্পেশাল প্ল্যানিং দরকার হবে। স্পেশাল প্ল্যানিং (স্থানিক পরিকল্পনা) করেই আমরা করেছি বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা, ছয়টি হট-স্পটে ভাগ করে প্রত্যেকটার জন্য আলাদা প্ল্যানিং করেছি, আলাদা কৌশল করেছি এবং আলাদা কর্মসূচি প্রণয়ন করেছি। প্রথম একটি পরিকল্পনা যেখানে স্থাণিক পরিকল্পনাকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। এটি এমন একটি টেকনো ইকোনমিক প্ল্যান যেখানে বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং কৌশলগত পরিকল্পনা একত্রে সন্নিবেশ করা হলো। আমাদের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা; আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (জুলাই ২০২১-জুন ২০২৫) যেটি ২০৪১-এর যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রথম পরিকল্পনা, এটা এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে ২০২১-২৫ সময়ে। কোনো পরিকল্পনা নিয়েই আমাদের কোনো বিতর্ক হয়নি, কোনো থিঙ্কট্যাঙ্ক, কোনো পত্রপত্রিকা বিরূপ কোনো মন্তব্য করেনি। তার মানে সামাজিকভাবে এগুলো ব্যাপকভাবে গৃহিত হয়েছে। আমরা গ্রামগুলোকে শহরে রূপান্তর করতে ব্যাপক রাস্তাঘাট করেছি, এমন কোনো গ্রাম নেই যে পাকা রাস্তা নেই, না থাকলেও আধা কিলোমিটারের মধ্যে আছে। দুর্গম চর, পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া, বাকিগুলো সংযুক্ত, বিদ্যুৎ প্রত্যেক গ্রামে নিয়ে গেছি। এগুলো কিন্তু পরিকল্পনা মাফিক হয়েছে, এলোপাতাড়ি হয়নি। প্রথম পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনায় বলেছি ২০০০০ মেগাওয়াট করব ২০২১-এর মধ্যে, করেছি ২৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা। স্বাস্থ্য খাতে এত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কিন্তু বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও উন্নয়ন মডেল কারণ মাতৃমৃত্যুর হার সবচেয়ে কম বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়ায়, শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম দক্ষিণ এশিয়ায়, আন্ডার নিউট্রিশন বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে কম, ক্ষুধার্তের সংখ্যা সবচেয়ে কম, খর্বাকৃতির শিশু বাংলাদেশে সবচেয়ে কম। ভারতকে মাথাপিছু আয়ে পেছনে ফেলেছি, মাতৃমৃত্যুতে পেছনে ফেলেছি। শিক্ষার হারে বাংলাদেশ একনম্বরে দক্ষিণ এশিয়ায়। প্রত্যাশিত গড় আয়ু আমাদের সবচেয়ে বেশি। এ সবই কিন্তু পরিকল্পনার ফোরকাস্ট ছিল, প্রক্ষেপণ ছিল, এসব কিছুই আমরা অর্জন করেছি। এখনো আগামী দিনগুলোর জন্য আমার আহ্বান থাকবে উন্নয়ন কর্মী ও গবেষকরা, এনজিও সংস্থাগুলো পরিকল্পনার দলিলগুলো দেখবেন, আত্মস্থ করবেন, আলোচনায় আনবেন নিজেদের কর্মসূচি তৈরিতে, আর কোথায় কি পরিবর্তন হলে ভালো হয় কীভাবে এর উন্নতি করা যায় তা পরামর্শ দেবেন। যদিও আমরা পরিকল্পনাগুলো গতিশীল দলিল হিসাবে তৈরি করেছি। মধ্যবর্তী মূল্যায়নে ওগুলো পরিবর্তনের সুযোগ রেখেছি। মধ্যবর্তী মূল্যায়ন করা হয়েছে প্রতিটি পরিকল্পনার। মধ্যবর্তী মূল্যায়নের পর লক্ষ্য অভীষ্ট সংশোধনও করেছি। বার্ষিক বাজেটের সঙ্গে পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটিয়েছি। পরিকল্পনার এমন দক্ষ বাস্তবায়ন আর অতীতে হয়নি। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে এখন প্রয়োজন প্রতিটি মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা যাতে প্রবৃদ্ধির হারকে কমপক্ষে ৯ শতাংশের ওপর নিয়ে যাওয়া যায়। সোনার বাংলার লক্ষ্য অর্জনে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা হবে এখন গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। পরিকল্পনাভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নে আসতে হবে জবাবদিহিতা, সময়মতো বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। আমাদের প্রক্ষেপিত সময়েই সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।