মেট্রোরেল : একটি অর্র্থনৈতিক বিশ্লেষণ

শিবলী কায়সার
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মেট্রো রেল মূলত একটি দ্রুত পরিবহণব্যবস্থা যা বিশ্বের অনেক বড় শহরে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় গণপরিবহণের জন্য ‘ঢাকা মেট্রো রেল’ হলো ‘জাইকা’-এর অর্থায়নে একটি সরকারি প্রকল্প। প্রকল্পটি রাষ্ট্রায়ত্ত ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) পরিচালনা করছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের গড় গতি ছিল প্রায় ২১ (২১.২ কিমি/ঘণ্টা), কিন্তু ২০১৫ সালে তা ৬ (৬.৮ কিমি/ঘণ্টা) এ নেমে আসে। ফলস্বরূপ, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাসে যেতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার বেশি। মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। এটি প্রত্যাশিত যে এ ধরনের পরিবহণ মানুষের জীবনধারা পরিবর্তন করে এবং তাদের উৎপাদনশীল সময় বৃদ্ধি করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
মেট্রো রেল বিশ্বের অনেক বড় শহরে গণপরিবহণের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। ১৮৬৩ সালে লন্ডনে প্রথম দ্রুত ট্রানজিট সিস্টেম চালু করা হয়েছিল, যা এখন ‘লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর একটি অংশ। ১৮৬৮ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এনওয়াইতে তার প্রথম দ্রুত ট্রানজিট রেলব্যবস্থা চালু করে এবং ১৯০৪ সালে, নিউইয়র্ক সিটি সাবওয়ে প্রথমবারের জন্য খোলা হয়েছিল। এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে, জাপান হলো প্রথম দেশ যেটি ১৯২৭ সালে একটি পাতাল রেলব্যবস্থা তৈরি করে। ভারত ১৯৭২ সালে কলকাতায় তার মেট্রো সিস্টেম নির্মাণ শুরু করে। এর পরে, ভারত অন্যান্য শহরেও মেট্রো রেলব্যবস্থা তৈরি করে। বর্তমানে, বিশ্বের ৫৬টি দেশের ১৭৮টি শহরে ১৮০টি পাতাল রেলব্যবস্থা চালু রয়েছে।
বাংলাদেশে মেট্রোরেল চালু করার জন্য সরকার ‘ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্পের ধারণা নিয়ে কাজ করছিল। অবশেষে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে, ‘ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ বা ‘মেট্রো রেল’ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) দ্বারা অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের জন্য মোট ৫টি রুট লাইন প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে এমআরটি লাইন ১, ২, ৪, ৫, এবং ৬। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এর অর্থায়নে ‘দ্য ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট সার্ভে (ডিএইচইউটিএস ১)’ মূল্যায়ন করা হয় এবং ‘এমআরটি লাইন-৬’ নামে মেট্রো রেলের জন্য প্রথম এমআরটি রুট নির্বাচন করা হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় আনুমানিক ২.৮২ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে জাইকা ০.০১ শতাংশ সুদের হারে প্রায় ৭৫ শতাংশ বা ২.১৩ বিলিয়ন ডলার প্রদান করছে। বাকি ২৫ শতাংশ তহবিল দেবে বাংলাদেশ সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জুন ২০১৬ সালে নির্মাণ কাজের সূচনা করেন। প্রাথমিকভাবে, ‘এমআরটি লাইন ৬’-এর দৈর্ঘ্য ২০.১ কিলোমিটার হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছিল, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত, যা পরে কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়, যার ফলে রুটটির দৈর্ঘ্য আরও ১.১৬ কিলোমিটার বৃদ্ধি পায়। এটির মোট দৈর্ঘ্য হবে ২১.২৬ কিমি.। রুটে মোট ১৭টি স্টেশন থাকবে এবং রুটে ২৪টি ট্রেন সেট চলবে। ২৯ আগস্ট ২০২১-এ, প্রথম ট্রায়াল রান দিয়া বাড়ি থেকে উত্তরা পর্যন্ত পরিচালিত হয়। মেট্রোরেল উত্তরা-আগারগাঁও রুটে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করবে। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ হলে, সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ঢাকা মেট্রো রেলে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৬০,০০০ যাত্রী বা প্রতিদিন ৯৬০,০০০ জন যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এমআরটি লাইন ১ মেট্রো রেল প্রকল্পের অধীনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রুট। এমআরটি লাইন ১, দুটি ভিন্ন রুটে নির্মিত হবে। ‘এয়ারপোর্ট রেল লিংক’ নামে পরিচিত প্রথমটি কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যা পরে গাজীপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়। এ রুটটি হবে প্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রো রেলব্যবস্থা যেখানে ভূগর্ভস্থ স্টেশনও থাকবে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে এর নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ লাইনটি প্রতিদিন প্রায় ৮০০,০০০ যাত্রী বহন করবে। এমআরটি লাইন ১-এর দ্বিতীয় রুটটি বারিধারা থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে, যা পূর্বাচল রুট নামে পরিচিত হবে। এ রুটটি হবে একটি এলিভেটেড রেল রুট। এমআরটি লাইন ১-এর দুটি রুটই ২০২৬ সালে নির্মাণ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এমআরটি লাইন ৪ নির্মাণ করা হবে, যা ২০৩০ সালে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এমআরটি লাইন ২ ‘গাবতলী’ থেকে ‘চিটাগং রোড’ রুটে পরিচালিত হবে, যা ২০৩০ সালে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় দুধরনের পরিবহণব্যবস্থা রয়েছে। একটি হলো পাবলিক বাস, লেগুনা এবং রিকশাসহ যাতায়াতের সাশ্রয়ী মাধ্যম। তবে অত্যধিক যানজট এবং অতিরিক্ত ভিড়সহ বিভিন্ন কারণের জন্য এ ধরনের পরিবহন ব্যবহার করার জন্য লড়াই করতে হয়। অন্যদিকে, সিএনজি এবং ট্যাক্সি ক্যাব পরিষেবাগুলোও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হিসাবে উপলব্ধ, তবে সেগুলো তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল। যদিও অনেক মানুষ পরিবহনের জন্য ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহার করে, তথাপি এটি সবার জন্য প্রনিধানযোগ্য বিকল্প নয়। মেট্রোরেল তাদের জন্য একটি সুবিধাজনক পরিবহণ পরিষেবা প্রদান করবে যারা ব্যয়বহুল গণপরিবহণ ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে কুলিয়ে উঠতে পারে না এবং সাশ্রয়ী পরিবহণের অভাবে ক্রমাগত ভোগান্তিতে পড়ে।
সরকারের প্রতিটি মেগাপ্রজেক্টেরই মুনাফা অর্জনের বাণিজ্যিক দিক রয়েছে। তবে অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রকল্পের মতো কেবল মুনাফা অর্জনই সরকার-প্রবর্তিত প্রকল্পের প্রাথমিক উদ্দেশ্য নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, সরকার ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং সাধারণত একটি বিশাল ভর্তুকি প্রদান করে যাতে জনগণ সাশ্রয়ী মূল্যের পরিষেবা থেকে উপকৃত হতে পারে। এ উদ্যোগের ফলে আর্থিক ক্ষতি হলেও দেশের অর্থনীতি অন্যান্য ক্ষেত্রে উপকৃত হয়।
মেট্রোরেল প্রকল্পটি বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে কিনা তা নির্ধারণ করতে, আমাদের প্রথমে এর ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। তবে মেট্রো রেলের চূড়ান্ত ভাড়া এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। এমআরটি লাইন ৬-এর ভাড়া নির্ধারণের জন্য সেপ্টেম্বর ২০২০-এ একটি ‘ভাড়া নির্ধারণ কমিটি’ গঠন করা হয়েছিল। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে, কমিটি ভাড়া নির্ধারণের জন্য প্রথম বৈঠক করেছিল। বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে বিনিয়োগ, পরিচালন ব্যয় এবং জনগণের সক্ষমতা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঢাকা ট্রিবিউন অনুসারে, কমিটি প্রতি কিলোমিটারে ২.৪ টাকা প্রস্তাব করেছে এবং ২১.২৬ কিলোমিটার রুটের মোট ভাড়া হবে ৫১ টাকা। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিআরটিএর সর্বশেষ ভাড়ার হার অনুসারে, বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ২.২ টাকা, যা মেট্রো রেলের ভাড়ার চেয়ে কম। তবে, বাসগুলো খুব কম ক্ষেত্রেই সরকারি ভাড়া অনুসরণ করে। কার্যত এর চেয়েও বেশি টাকা নেয় তারা।
তবে ভাড়া নির্ধারণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি, এ বিষয়ে অনেক কাজ বাকি আছে। প্রতিদিন মেট্রো রেল পরিচালনা করতে প্রায় ২.৩৩ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। সুতরাং প্রতিদিন ৪৮৩,০০০ জন যাত্রী মেট্রো রেল ভ্রমণ করলে এটাকা উঠে আসবে। তবে ভাড়া সম্পর্কিত এ উপাত্তগুলো এখনো প্রাথমিক প্রস্তাবনা মাত্র, মেট্রো রেলে ভ্রমণের প্রকৃত খরচ এখনো ঠিক করা হয়নি।
কাজেই বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীদের বেতন, রক্ষণাবেক্ষণ, বৈদেশিক ঋণ এবং সরকারি বিনিয়োগের রিটার্নসহ এমআরটি-এর সব খরচ মেটানোর জন্য ভাড়ার টাকা যথেষ্ট হবে না। সে জন্য ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) নন-ফেয়ার উৎস থেকে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ রাজস্ব তৈরি করার পরিকল্পনা করছে। প্রতিটি স্টেশনে ট্রানজিট-ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি), স্টেশন প্লাজা এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক সুবিধা সংযুক্ত করা হবে। উত্তরা নর্থ স্টেশন, আগারগাঁও ও মতিঝিল স্টেশন সংলগ্ন স্টেশন প্লাজা নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া ফার্মগেট স্টেশনেও একটি স্টেশন প্লাজা দেখা যেতে পারে।
ইউএনবির মতে, কর্তৃপক্ষ স্টেশনগুলোর কাছাকাছি কয়েকটি টিওডি হাব নির্মাণের পরিকল্পনা করছে যার মধ্যে একটি বিশ্বমানের বিনোদন পার্ক, হোটেল, দৈনন্দিন পণ্যের বাজার এবং শপিং মল অন্তর্ভুক্ত থাকবে। উত্তরায় প্রথম টিওডি হাব নির্মাণ করা হবে। তাই টিওডি হাব ও স্টেশন প্লাজা তৈরির জন্য রাজউক থেকে উত্তরায় ২৮.৬১৭ একর জমি কেনা হয়েছে।
ভাড়া এখনো চূড়ান্ত না হলেও মেট্রোরেলের যে সময় ব্যয় হবে তা মোটামুটি অনুমেয়। একই রুটে বাসে যাতায়াতের সময়ের চেয়ে মেট্রোরেলে যাতায়াতের সময় তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত একটি বাসে যেতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা এবং ভিড়ের সময়ে সময় লাগে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। মেট্রো রেলে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট।
যানজটের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশ এর বেশি। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট কর্মঘণ্টার মূল্য বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করে যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেনের মতে, ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমাতে পারলে বাংলাদেশ ২.৬ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে। এ ছাড়া ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুসারে, মেট্রো রেল প্রকল্পটি প্রতি বছর ২.৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে যা জাতীয় জিডিপির ১.৫ শতাংশ এর সমান। তা ছাড়া মেট্রো রেল ঢাকার ১৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য যাতায়াত সহজ করবে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে গতিশীল করবে, যা অর্থনীতিতে একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে।
মেট্রো রেল পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রচুর লোকবলের প্রযয়োজন হবে, যা বাংলাদেশে অনেক কাজের সুযোগ তৈরি করবে। ইউএনবির মতে, প্রতিটি মেট্রো রেলস্টেশনে একটি অপারেটিং রুম, টিকিট কাউন্টার, লাউঞ্জ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট, প্রার্থনার স্থান, অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা, এসকেলেটর, লিফট এবং আরও অনেক কিছু থাকবে। কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে নতুন কর্মচারী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। তা ছাড়া, স্টেশনগুলোর আশপাশের বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোতে ব্যবসা পরিচালনার জন্য একদল কর্মীর প্রয়োজন হবে। এসব কর্মসংস্থান আর্থিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি করবে এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
মেট্রো রেলের কারণে, ট্রানজিট ব্যবস্থা বাড়বে, এবং স্টেশনগুলোর আশপাশে অসংখ্য ব্যক্তিগতভাবে পরিচালিত ব্যবসা গড়ে উঠবে। তদ্ব্যতীত, উন্নত পরিবহণ পরিকাঠামোর কারণে, নতুন সংস্থাগুলো বিকাশের সুযোগ পাবে, অন্যদিকে বর্তমান ব্যবসাগুলো উপকৃত হবে। সামগ্রিকভাবে, স্টেশন এবং রুটের কাছাকাছি স্থাপন করা এ ব্যবসাগুলো দেশের জিডিপিতে যথেষ্ট অবদান রাখবে।
পিক আওয়ারে বাস না পাওয়া, অতিরিক্ত ভিড়, অল্প ব্যবধান, বাস কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার ইত্যাদি কারণে ঢাকা শহরের মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে। ট্যাক্সি এবং সিএনজি ছিল বাসের বিকল্প। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়া, ‘মিটার ভাড়া’ ব্যবহার না করার প্রবণতা, যাতায়াতের অনুরোধ কমে যাওয়া, সিএনজিতে ছিনতাই ও মলম পার্টির উৎপাত এবং চালকদের দুর্ব্যবহার জনগণের জন্য সীমাহীন দুর্ভোগ সৃষ্টি করে।
ঢাকাবাসীর যাতায়াতের একটি সুবিধাজনক মাধ্যম হবে মেট্রোরেল। কারণ এটি প্রচুর যাত্রী বহন ক্ষমতাসহ একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহণ সুবিধা প্রদান করবে, এটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৬০,০০০ যাত্রী বহন করবে এবং প্রতি ৪ মিনিটে প্রতিটি স্টেশনে একটি ট্রেন যাতায়াত করবে। তা ছাড়া, বিদ্যমান গণপরিবহণ ব্যবহারে নারীরা প্রায়ই হয়রানির সম্মুখীন হন। এর মধ্যে রয়েছে পিক টাইমে দীর্ঘ অপেক্ষার সময়, শারীরিক বা মৌখিক হয়রানি, আসনের স্বল্পতা, নিরাপদে বাসে উঠা বা নামা এবং উপযুক্ত পরিবহন খোঁজা। এসব কারণে নারীরা বিদ্যমান পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করছে। সুতরাং, তারা মেট্রো রেলে ভ্রমণে আরও আগ্রহী হবে। ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে।
মেট্রো রেল আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি নতুন যুগে আবদ্ধ করবে। উন্নত দেশগুলোয় মেট্রো রেল এবং অন্যান্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন মাধ্যমগুলোকে একত্রিত করে একটি উন্নত রুট সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে যাতে মানুষ শুধু একটি পেমেন্ট কার্ডের মাধ্যমে তাদের গন্তব্যে ভ্রমণ করতে পারে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে মেট্রোরেলে ব্যবস্থা তৈরি করা হচ্ছে। সিস্টেমটি ধীরে ধীরে সব ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে প্রসারিত করা যেতে পারে। এটি দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন আনার পাশাপাশি ধীরে ধীরে নগদবিহীন অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকা শহর থেকে জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানো যাবে। মানুষ বাসা ভাড়া অনেক কম খরচ করে শহরের বাইরে থাকতে পারে এবং অফিস ও অন্যান্য কাজে সহজে ঢাকায় আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জ এলাকায় বসবাসকারী লোকেরা সমস্ত রুট সম্পূর্ণ হয়ে গেলে এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে মূল শহরে যেতে পারে। প্রতিটি মেট্রোরেল রুটে ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। সুতরাং, পুরো ট্রানজিট সিস্টেমটি কাছাকাছি শহরে প্রসারিত করা যেতে পারে। বর্তমানে এসব এলাকায় বসবাসকারী লোকজনও সেখানে বসবাস না করে মূল শহরের কর্মী বাহিনীতে যোগ দিতে পারেন।
তা ছাড়া, অনেক বাণিজ্যিক উন্নয়ন ঘটবে এবং রুটের চারপাশে সুবিধাগুলোর ভাড়া এবং মূল্য বাড়বে। দ্বিতীয়ত, আবাসিক ভবন বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য পুনঃনির্মাণ করা হবে। ফলস্বরূপ, ওইসব এলাকায় বসবাসকারী লোকজন কম ভাড়ার জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হবে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষ কেন্দ্রীয় শহর থেকে বিকেন্দ্রীভূত হবে।
ঢাকার রাস্তায় চলমান সব যানবাহন জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করে, যা পরিবেশ দূষণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। এ ছাড়া ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের উদ্যোগ চলছে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা ধারাবাহিকভাবে শীর্ষে রয়েছে। মেট্রো রেল রাজধানীর পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ঢাকার বায়ুদূষণ অন্যান্য মেগাসিটির তুলনায় অনেক বেশি তীব্র। যেহেতু মেট্রোরেল ‘বিদ্যুৎ চালিত’ এবং প্রতি ঘণ্টায় বেশি যাত্রী বহন করতে পারে, তাই ঢাকায় বাস ও অন্যান্য পরিবহনের মাধ্যমে যাতায়াতের প্রবণতা কমে যাবে। এতে সড়কে যানবাহনের সংখ্যা কমবে, যা পরিবেশের জন্য উপকারী হবে। এ ছাড়া শব্দ, শক এবং কম্পন কমাতে মেট্রো রেলে ম্যাস স্প্রিং সিস্টেম [এমএসএস] প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। শব্দদূষণ রোধে কংক্রিটের পাশের দেওয়ালও করা হবে। এ প্রযুক্তি পরিবেশের ওপর মেট্রোরেলের প্রভাব কমাবে।
কাজেই, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, মেট্রোরেল সেই স্বপ্নের প্রকল্প যে প্রকল্প ঢাকা শহরকে বর্তমান অবস্থা থেকে আধুনিক কসমোপলিটনে রূপান্তর করবে। বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বে পদার্পণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। ধারাবাহিক উন্নয়ন অব্যহত থাকলে সে সময় বেশি দূরেও নয়। সেই সোনালি ভবিষ্যতের উন্নত মহানগর ঢাকার অপরিহার্য অনুষঙ্গ মেট্রোরেল আজ বাস্তব।
লেখক : কবি, এম. ইঞ্জি, আইপিই বিভাগ, বুয়েট