চতুর্থ শিল্পবিপ্লব : সম্ভাবনা ও প্রস্তুতি
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তিগত আলোড়ন সর্বত্র বিরাজমান। এ বিপ্লব চিন্তার জগতে, পণ্য উৎপাদনে ও সেবা প্রদানে বিশাল পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। মানুষের জীবনধারা ও পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি ব্যাপকভাবে বদলে দিচ্ছে। জৈবিক, পার্থিব ও ডিজিটাল জগতের মধ্যেকার পার্থক্যের দেয়ালে চির ধরিয়েছে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিক্স, ইন্টারনেট অব থিংস, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, থ্রিডি প্রিন্টিং, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও অন্যান্য প্রযুক্তি মিলেই এ বিপ্লব। এ বিপ্লবের ব্যাপকতা, প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকতা ও এ সংশ্লিষ্ট জটিল ব্যবস্থা বিশ্বের সরকারগুলোর সক্ষমতাকে বড় ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীনও করেছে। বিশেষত যখন তাবৎ সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা তথা এসডিজির আলোকে ‘কাউকে পিছিয়ে ফেলে না রেখে’ সবাইকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। টেকসই উন্নয়ন, বৈষম্য হ্রাস, নিরাপদ কর্ম এবং দায়িত্বশীল ভোগ ও উৎপাদন এসডিজি বাস্তবায়ন ও অর্জনের মূল চ্যালেঞ্জ।
১৭ শতাব্দীতে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে গতানুগতিক উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রথম শিল্পবিপ্লব সূচিত হয়। ১৯ শতকের শুরু থেকে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের আরম্ভ। একালে জ্বালানির নতুন উৎসগুলো যেমন বিদ্যুৎ, তেল এবং গ্যাস ইত্যাদি উদ্ঘাটিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কম্পিউটার প্রযুক্তি, সেমিকন্ডাক্টর, মাইক্রোচিপস ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিকাল যন্ত্রপাতি ও আণবিক শক্তিসহ অন্যান্য উদ্ভাবন নিয়ে তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। এ শিল্পবিপ্লব ইন্টারনেট, মোবাইল যোগাযোগ ইত্যদি প্রদান করেছে এবং আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, ঔষধশিল্প ও বায়োটেকনোলজি ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের জীবন ধারায় প্রতিনিয়ত ব্যাপকতর পরিবর্তন নিয়ে আসছে। মানুষের জীবনে এ বিপ্লবের প্রভাব এবং পরিবর্তনের গুণগত মাত্রা ও ব্যপ্তি আগের তিনটি বিপ্লবের সঙ্গে অতুলনীয়।
উন্নয়ন ও বাজার
ডিজিটাল বিপ্লব ‘সবার জন্য অবারিত সুযোগ তৈরি’র আশা জাগিয়েই চলছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কর্মঘণ্টা হ্রাস এ প্রযুক্তির সহজাত সক্ষমতা। এ বিপ্লব কম কর্মঘণ্টা হ্রাসকে মানুষের স্বাধীনতা ও আত্ম-পূর্ণতা পূরণের সোপান হিসেবেই দেখছে। অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় দক্ষতা ঘাটতির কারণে বিশ্বেও প্রায় ৮০ কোটি মানুষ চাকরি হারাতে পারে। এ সংস্থার মতে, এ সময়কালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেশে ও বিদেশে চাকরিরত প্রায় ৫৭ লাখ অদক্ষ শ্রমিক এ প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থতার কারণে বেকার হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের আশঙ্কা নিঃসন্ধেহে চিন্তা উদ্বেগকারী। বিশেষত বাংলাদেশে বর্তমানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে কম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী, বৈষম্য তৈরিকারী ও শ্লথগতির দারিদ্র্য হ্র্রাসকারী প্রবৃদ্ধি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবানুযায়ী, আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস পেয়েছে। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের সেবা খাত ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন খাতের চেয়ে বড় আকার ধারণ করায় সমস্যা প্রকটতর হয়েছে। উন্নত দেশের কাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সেবা খাতের বৃদ্ধি উৎপাদন খাতের তুলনায় অতিদ্রুত হয়নি। ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন খাতে সেবা খাতের তুলনায় অনেক আগেই কম উৎপাদন ও কর্মসংস্থানকে ‘অকালীন বি-শিল্পায়ন’ বা অপরিপক্ব শিল্পায়ন বলে। উন্নত বিশ্বেও উন্নত হওয়ার ঐতিহাসিক বাস্তবতার আলোকে বহুবছর ধরেই উন্নয়ন শাস্ত্রবীদ একমত যে- কৃষির ওপর নির্ভরশীল অর্ধ-বেকারদের শিল্প খাতে নিয়োজনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় ও শিল্প খাতের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে রূপান্তর প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। কৃষি খাতে নিযুক্ত ছদ্ম-বেকারেরা ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে যোগ দান করে। এতে করে নতুন কাজ পাওয়া শ্রমিকের আয় বৃদ্ধি হওয়ায় ও ব্যয় করার সামর্থ্য অর্জন করায় ভোগ ব্যয় ও চাহিদা বাড়ায় উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। আর এ পুণ্যচক্রই দুষ্টচক্রের ক্ষতকে হ্রাসকরণের মাধ্যমে জাতীয় আয় তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে থাকে। কৃষি খাতে নিযুক্ত ছদ্ম-বেকারদের গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের মাধ্যমেই এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস এ বাস্তবতার প্রমাণ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের গল্পটিও এমনই; কোন কল্পিত ‘উন্নয়ন আশ্চর্য’ চিত্রায়ণের অবকাশ নেই।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। মানুষের মেধা ও অভিজ্ঞতার বিরতিহীন প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে অর্জিত হয়েছে। জনগণের তথা করদাতাদের অর্থায়নে এ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্ভবপর হয়েছে। বৃহৎ কোম্পানিগুলো মূলত সরকারি অর্থায়নে আবিষ্কৃত প্রযুক্তিগুলোকে নিজেদের করায়ত্ত করে একচেটিয়া বাজার তৈরি করছে। এতে করে যা ছিল সরকারি অর্থায়নে সৃষ্ট গণপণ্য, এখন তা হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য। দ্বিতীয়ত, এ বৃহৎ কোম্পানিগুলো ব্যাপক মুনাফা করছে। এই হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি সামান্য সংখ্যক বেতনভুক্ত কর্মচারী নিয়োগ করে। যাদের এ প্রযুক্তির ব্যবহারকারী বলা হয়, তারাই অধিকাংশ এ প্রযুক্তি উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু তাদের মজুরি দিতে হয় না; বরং তারা ভোক্তা বা ক্রেতা হিসেবে এ বাজারে নিয়োজিত। এই একচেটিয়া কোম্পানিগুলো দুই প্রক্রিয়ায় উদ্বৃত্ত অর্জনের মাধ্যমে অত্যধিক অস্বাভাবিক মুনাফা করছে। একদিকে তাদের স্বেচ্ছায় ব্যবহারকারী তথা উৎপাদনকারীদের মজুরি দিতে হচ্ছে না। অন্যদিকে ভোক্তার কাছেই পণ্য বা সেবা বিক্রি করে মুনাফাও পাচ্ছে। অথচ সনাতনী উৎপাদন ব্যবস্থায় বেতনভুক্ত কর্মচারীর নিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন হয়। তৃতীয়ত এ ডিজিটাল বাজারকে ভোক্তাদের জাগতিক কল্যাণের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু বহু গবেষণায় অসংখ্য তথ্য ও উপাত্ত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, যে ভোক্তাদের কোম্পানির তুলনায় অসম্পূর্ণ তথ্য থাকায়, অসম ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় এবং মায়জাল ও প্রতারণার সাহায্যে মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পদ্ধতিগতভাবে শোষণ ও প্রান্তিকীকরণ করা হয়। ডিজিটাল বাজারগুলো ন্যায়ভিত্তিক হওয়ার পরিবর্তে অজ্ঞ গ্রাহকদের বোকা বানাচ্ছে। এ জাতীয় বাজারব্যবস্থা যদি সর্বস্তরে নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে প্রান্তিক ভোক্তাদের স্বাধীনতা এবং আত্ম-পূর্ণতার সুযোগ দেয়ার পরিবর্তে শোষণ ও নিপীড়নের সুযোগ তৈরি করে দেবে।
কর্মসংস্থান ও দক্ষতা
ই-প্রস্তুতি (ই-সাক্ষরতা ও ই-দক্ষতা) একটি ডিজিটাল সমাজের জন্য মৌলিক শর্ত। ই-প্রস্তুতি একজন নাগরিককে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সম্পূর্ণরূপে অংশ নেয়ার ক্ষমতা বাড়ানোর আশা জাগায়। চিহ্নিত চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে নতুন কৌশলে নির্ধারণ করে প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়ন ও বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতার বিকাশ ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাংলাদেশের বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি থেকে বাঁচার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি জনমিতিক ফলাফল বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের বয়স ২৪ বছরের নিচে। কিন্তু যুব-বেকারত্বের এবং অর্ধ যুব-বেকারত্বের হার যথাক্রমে ১০.৯% ১৮.১৭%। তা ছাড়া শ্রমবাজারে ক্রমবর্ধমান নতুন প্রবেশকারীদের তুলনায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। প্রতি বছর ২.২% হারে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়ে এবং শ্রমবাজারে ২০ লাখ কর্মক্ষম নতুন মানুষ প্রবেশ করে। এর মধ্যে ১০ লাখের কর্মসংস্থান হয়। আর বাকি ১০ লাখ চাকরি পায় না।
এ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগাতে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। মোট জনসংখ্যার ৫৮.৫% অর্থনীতিতে ক্রিয়াশীল এবং তাদের মধ্যে মাত্র ৫.৩% বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষিত। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের মাত্র ০.৩% কর্মসংস্থান হয়েছে। নতুন করে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বিপুলসংখ্যক দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ও জোগানের বিষয়টি আলোচিত হয়। এ দেশে মেধাবী, দক্ষ ও সম্ভাবনাময় তরুণ রয়েছে। কিন্তু এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন অনুযায়ী গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। ব্যক্তি নিজে চাইলেই দক্ষতা বাড়াতে পারে না।
বরং দক্ষতা বাড়াতে প্রয়োজন হয় গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের। এ প্রশিক্ষণের প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু হতে হয়। তারপর মাধ্যমিক ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শক্তিশালী এবং উচ্চশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে কর্মক্ষম জনশক্তির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য গুণগত প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। প্রয়োজন সরকারি বিনিয়োগ ও ব্যক্তি খাতের পৃষ্ঠপোষকতা।
উদ্যোগ ও অবকাঠামো
প্রত্যাশা করা হয়, যদি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনবল গড়ে তোলা যায় তবে পোশাক শিল্প খাতের রফতানিকেও অতিক্রম করে একটি বহুমুখী রফতানিনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা যাবে। বর্তমানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার রফতানি আয়। অর্থাৎ এ খাত থেকে ৪০ গুণের বেশি রফতানি আয় হতে পারে। অধিকাংশ আইটি ফার্মগুলো ছোট আকারের এবং কিছু আন্তর্জাতিক ফার্ম সীমিত পরিসরে এখানে আছে। প্রত্যাশা করা যায়- যদি প্রয়োজনমতো অবকাঠামো, আর্থিক প্রণোদনা এবং যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা যায়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য বাংলাদেশর মতো উন্নয়শীল দেশে অবকাঠামো একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন অ্যানালাইটিক্স, নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট ও স্মার্ট ডিভাইস উন্নয়ন বাধার মুখে পড়ছে দুর্বল অবকাঠামোর কারণে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশন দুর্বলতা এখনও প্রকট। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের তথ্যমতে, বর্তমানে ই-কমার্সের ১০০০টি সাইট রয়েছে এবং ফেসবুকে মোট ৮০০০টি পেজ রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সেবা ও আর্থিক লেনদেন অনলাইনে করছে। তা ছাড়া মোবাইলে আর্থিক সেবা আদান-প্রদানকে সহজ করেছে। কিন্তু এখনও চার কোটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিপরীতে মাত্র ৮৩ লাখ ডেবিট কার্ড ব্যবহার হয়। আর ইন্টারনেট ব্যাংক সেবা ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র ১৫ লাখ।
গণদ্রব্য ও রাজস্ব
বর্তমানে বিগডাটা নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে। বিগডাটা গণদ্রব্য বা পাবলিক গুডস। জনসাধারণের সৃষ্ট সম্পদ। জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করে যাতে কেউ একচেটিয়া ব্যবসা না করতে পারে, তা নিয়ে কার্যকরী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। ব্লকচেইনকে বিপুল সম্ভাবনার বিকেন্দ্রীকৃত, বিতরণযোগ্য এবং জনসাধারণের প্রযুক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কোনো মাধ্যম ব্যবহার না করে ভোক্তাকে সরাসরি সেবা প্রদান করা যায় ব্লকচেইন ব্যবহার করে। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে খরচ বেশি পড়ছে। যেমন ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রেই কম খরচে সর্বশেষ পর্যায়ের ভোক্তাকে সেবা প্রদান করে আসছে। নিয়ন্ত্রণমূলক তদারকির অভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারে কারসাজি করে অস্থিরতা সৃষ্টির উদাহরণ রয়েছে। ব্লকচেইন ব্যবহারে প্রচুর পরিমাণে কম্পিউটার ব্যবহারের কারণে অনেক বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। ফলে অতিরিক্ত মাত্রার জীবাশ্ম জ্বালানির দরকার পড়ে। এতে করে চলমান জলবায়ু সংকটকে প্রকটতর করতে পারে, যা টেকসই উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তা ছাড়া বৃহৎ কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আয়কর নিবাসী না হওয়ায় এবং সঠিক ধরনের করারোপ না করায় সরকার বিপুল রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদিও এসব কোম্পানিগুলো উন্নয়নশীল দেশে বিপুল পরিমাণ ব্যবসা করছে।
রাজনৈতিক ও জীবনব্যবস্থায় পরিবর্তন
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব জনগণের মতামত প্রকাশের, তাদের সমন্বিত চেষ্টা গ্রহণের ও সরকারকে প্রভাবিত করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আবার প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারও জনমত সৃষ্টি করতে পারে। নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা নির্ভর করে সরকার বা রাষ্ট্রের ইচ্ছার ওপর। আবার সরকার ডিজিটাল প্লাটফরম নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ অপব্যবহারও করতে পারে, যা মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করে। যেমন বাংলাদেশের ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’-কে অনেকে মানবাধিকার সংস্থা মানবাধিকার ক্ষুণ্নকারী আইন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো মানুষকে মানবতাবাদী ও পরার্থপর করে তুলছে। যেমন সারা বিশ্বের স্বেছাব্রতী চেষ্টায় ‘উইকিপেডিয়া’র মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া কেউ তার বন্ধুভাবাপন্ন মানুষকে সমর্থন দিচ্ছে, আবার কেউ বঞ্চিত মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলছে।
বর্তমানে প্রযুক্তি মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারা, সমাজ ও সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। সমাজে নতুন আচার ব্যবহার ও সংস্কৃতি প্রযুক্তির মাধ্যমে ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের মতামত, ধারণা, আদর্শ ও দর্শন সৃষ্টি হচ্ছে এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষকে অনেক অজানাকে জানার এবং অতীতের চেয়ে অনেক বেশি নিজেদের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এভাবে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অনেক আদর্শ ও আচরণকে প্রভাবিত করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে জনতুষ্টিবাদী নেতারাও তাদের সমর্থকদের আবেগতাড়িত করে নিজের মতাদর্শে পরিচালিত করছে। আবার অন্যমতাদর্শ গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখছে। নিঃসঙ্গও করে দিচ্ছে।
অনেক প্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ড্রোনজাতীয় প্রযুক্তিগুলো মানবাধিকার, সার্বভৌমত্ব এবং নাগরিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার উদাহরণও রয়েছে। মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে এবং দুর্বল দেশের সার্বভৌমত্ব ঝুঁকিতে ফেলছে। অ্যাডভোকেসি গ্রুপ, ট্রেড ইউনিয়ন, শিশু-অধিকার সংগঠন এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল হুমকি এবং আক্রমণের শিকার হচ্ছে। আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার বন্ধ না করা গেলে ভবিষ্যতে রোবটিক যুদ্ধেরও আশঙ্কা থেকে যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বৈশ্বিক পর্যায়ে বহুপাক্ষিক বাধ্যবাধকতাযুক্ত চুক্তি দরকার। ফলে প্রযুক্তিগত রূপান্তরকে ধ্বংসের অস্ত্র হিসেবে নয় বরং মানুষের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পুরো জীবনব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষ, প্রকৃতি এবং সমাজের সর্ম্পক বৃহত্তর রূপান্তর হতে পারে। এ ডিজিটাল ব্যবস্থার মধ্যে থাকা সব অংশীজনদের অবশ্যই তাদের ন্যায়সঙ্গত অংশ ভোগ করার সুযোগ থাকতে হবে। অন্যথায় প্রান্তিকীকরণ বেড়ে যাবে। নিশ্চয়ই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কাঙ্ক্ষিত ভালো পথই খুঁজে নেবে।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপার্সন