আর্থিক খাতের অভিশপ্ত নাম সালমান এফ রহমান
ঋণখেলাপি, অর্থ পাচার এবং শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে শীর্ষে
মনির হোসেন
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সালমান এফ রহমান। দেশের ব্যাংক খাত ও শেয়ারবাজারে অভিশপ্ত এক নাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। লম্বা দাড়ি ও সাদা পোশাকের কারণে ‘দরবেশ’ নামে সবার কাছে বেশ পরিচিত। ভারতের নিষিদ্ধ হওয়া ইসলামী বক্তা ড. জাকির নায়েকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে দরবেশ নামটি আরও ব্যাপকতা পায়। কিন্তু এর আড়ালে ছিল ভয়ংকর জালিয়াতি ও প্রতারণা। সম্পদের চেয়ে দায় অনেকগুণ বেশি। শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি এবং কারসাজির কথা বললেই যে নামটি সবার মনের পর্দায় ভেসে উঠে তিনি সালমান এফ রহমান। ১৯৯৩ সাল থেকে গত ৩১ বছরে শেয়ারবাজারে এমন কোনো বড় কেলেঙ্কারি নেই, যেখানে সালমান এফ রহমানের সম্পৃক্ততা মেলেনি। এসব কাজে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করেছেন। কারসাজির নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি। শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি ও অর্থ পাচারের কারণে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট দেয় পুলিশের অপরাধ বিভাগ সিআইডি। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে ৫ আগস্ট বিদেশে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দেশেই পালিয়ে ছিলেন তার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। মঙ্গলবার তিনি ঢাকার নারায়ণগঞ্জ থেকে কোস্টগার্ডের হাতে গ্রেফতার হন। নিউমার্কেট থানায় পুলিশের করা মামলায় বুধবার তাকে ১০ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। এরপরই তার নামটি সামনে আসে। সালমান এফ রহমানের জন্ম ১৯৫১ সালের ২৩ মে।
ম্যাট্রিক পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের করাচিতে পড়াশোনা করেন। এরপর বাংলাদেশে এলেও ১৯৭১ সালে অনার্স পরীক্ষার সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান তিনি। করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করে ১৯৭২ সালের মে মাসে লন্ডন চলে যান। সেখান থেকে ওই বছরই সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট কোম্পানির (বেক্সিমকো) যাত্রা শুরু। আশির দশকে ওষুধ শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ হওয়ার পর চালু হয় বেক্সিমকো ফার্মা। এরপর টেক্সটাইল খাতে। কিন্তু ৯০ দশকের শুরুতে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ব্যাংক, বিমা, জ্বালানি ও বিমান পরিবহণে ব্যবসা সম্প্রসারণ হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ওই বছরই শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ক্ষমতার বেপরোয়া ব্যবহার, দুর্নীতি, প্রতারণা এবং জালিয়াতি হয় তার সম্পদ বাড়ানোর হাতিয়ার।
ঋণখেলাপি, জমি জালিয়াতি, অর্থ পাচার, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি বললেই তার নাম সবার আগে। তার হাত ধরেই দেশের ঋণখেলাপির সংস্কৃতির বিকাশ হয়। অর্থাৎ এই জগতে একচ্ছত্র আধিপত্য। বিভিন্ন তথ্য বলছে, নামে-বেনামে তার ঋণের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শুধু জনতা ব্যাংকেই বেক্সিমকোর ২৯ প্রতিষ্ঠানের ঋণ সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে পরিশোধিত মূলধনের ৯৩৪ শতাংশ ঋণ দেওয়া হয়েছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত দুই কোম্পানি বেক্সিম লিমিটেড এবং বেক্সিমকো ফার্মার ঋণ ৬ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। কিন্তু এই দুই কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ পরিশোধিত মূলধনের ৬ গুণ ঋণ কোম্পানি দুটিতে। এরমধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেড ৫ হাজার ৯৫৭ কোটি এবং বেক্সিমকো ফার্মার ৭৪৬ কোটি টাকা।
শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির কথা বললেই যে নাম মানুষের কল্পনা ভেসে উঠে তিনি সালমান এফ রহমান। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে তার। সেই সম্পর্ককে প্রতারণার কাজে লাগিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম ২০০৬ সালে রূপালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি। রূপালী ব্যাংক বিক্রির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করে। দরপত্রে অংশ নিয়ে সৌদি যুবরাজ প্রিন্স বন্দর বিন মোহাম্মদ আবদুল রহমান আল সৌদ ব্যাংকের ৯৩ ভাগ শেয়ারের জন্য ৪৫ কোটি ডলার মূল্য প্রস্তাব করেন। এর আগে রূপালী ব্যাংকের শেয়ার কিনে আটকান সালমান এফ রহমান। কিন্তু পরে জানা যায় ওই নামে সৌদিতে কোনো যুবরাজ নেই। অর্থাৎ সৌদি যুবরাজ নামে ভুয়া এক ব্যক্তি সাজিয়ে রূপালী ব্যাংক কেনার নাটক সাজান। এই সময়ে রূপালী ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৪শ টাকা থেকে ৩ হাজার ৪শ টাকায় উন্নীত হয়। এই প্রক্রিয়ায় রূপালী ব্যাংকের শেয়ার থেকে ৯শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। গত ৩ বছরে শেয়ারবাজার থেকে দৃশ্যমান ৬ হাজার ৬শ কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি। এরমধ্যে বেক্সিমকো সুকুক বন্ড ৩ হাজার কোটি, আইএফআইসি আমার বন্ড ১ হাজার কোটি এবং বেক্সিমকো জিরো কুপন বন্ড ছেড়ে ২ হাজার ৬শ কোটি টাকা নিয়েছেন। তবে অদৃশ্য ও বেনামি মিলিয়ে ৩ বছরেই ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এদিকে সুকুক বন্ড কেনার জন্য বিভিন্ন ব্যাংককে বাধ্য করা হয়।
১৯৯৬ সালে শাইন পুকুর সিরামিক ও দোহা সিকিউরিটিজের কেলেঙ্কারিতে জড়ান তিনি। ওই সংক্রান্ত মামলার এখনও তিনি আসামি। মামলাটি উচ্চ আদালতে চলমান। শেয়ারবাজার কারসাজি নিয়ে ২০১১ সালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্টেও তার নামে আসে। ওই সময়ে প্রভাব খাটিয়ে বেক্সিমকো ফার্মার প্রেফারেন্স শেয়ার পাশ করিয়ে নেন তিনি। এই শেয়ারের মাধ্যমে প্রিমিয়ামসহ ৪১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। একই সময়ে শাইন পুকুর সিরামিকের মাধ্যমে ২৮৬ কোটি এবং বেক্সিমকো টেক্সটাইলের মাধ্যমে ৬৩৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। এছাড়াও জিএমজি এয়ারলাইন্সের প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে ৩শ কোটি টাকা নেন তিনি। পরে ওই কোম্পানি উধাও হয়ে যায়। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আর টাকা ফেরত দেননি। একইভাবে জিএমজি এয়ারলাইন্সের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে ২২৮ কোটি ঋণ নেন তিনি। এক্ষেত্রে জানামত হিসাবে সালমান এফ রহমানের ধানমন্ডির বাড়ি বন্ধক রাখা হয়। পরে টাকা শোধ না করলে তার বাড়ি নিলাম ডাকে সোনালী ব্যাংক। ২০১৩ সালের আইএফআইসি ব্যাংকের টাকায় নেপালের লোকসানি প্রতিষ্ঠানের ১০ টাকার শেয়ার ৭৫ টাকায় কেনেন তিনি। এই প্রক্রিয়ায় সেখানে ১২৫ কোটি টাকা পাচার করা হয়। ২০১১ সালে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে আইএফআইসি মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে ১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেন।
গত কয়েক বছরে সালমান এফ রহমানের অর্থ পাচারের বিষয়টি সামনে আসে। তার ব্যবসার বড় অংশই দুবাই এবং সিঙ্গাপুরে। চীনের পত্রিকার হুরুন গ্লোবালের তথ্য অনুসারে সালমান এফ রহমানের সম্পদের পরিমাণ দেড় বিলিয়ন ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় তা ১৮ হাজার কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ২০২০ সালে বিমার হাজার কোটি টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে দেশে মামলা হলে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলে দেশে আনেন সালমান। এরপর ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স দখল করে নেন।