কর্মচঞ্চল গার্মেন্ট কারখানা
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
টানা ৪ দিন পর বুধবার সারা দেশে কলকারখানা খুলেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নরসিংদী ও নারায়ণঞ্জে সব শিল্প এলাকায় শ্রমিকরা সকাল থেকে কাজে যোগ দেন। কর্মমুখর ছিল চট্টগ্রামের দুই ইপিজেড। হাজার হাজার শ্রমিকের উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে উঠছে দেশের নিট গার্মেন্ট শিল্পের প্রধান কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ। ফতুল্লার বিসিক, সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী ইপিজেড, কাচপুর শিল্প এলাকাসহ আশপাশ ঘুরে দেখা গেছে এমনই চিত্র। কারফিউর মধ্যেই শ্রমিকরা সকালে কারখানায় প্রবেশ করেন। এদিন অফিস-আদালত ও দোকানপাট খোলায় সারা দেশেই কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে। রাজধানী ঢাকা ফিরে পায় চিরচেনা রূপ। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বন্ধ থাকায় রাজধানীজুড়ে যানজট ছিল লক্ষণীয়। কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। চট্টগ্রাম ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
গার্মেন্ট মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে মঙ্গলবার রাতে মোবাইল ফোনে শ্রমিকদের কারখানায় আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। বুধবার সকাল থেকে কলকারখানায় শ্রমিকরা প্রবেশ করে। প্রায় সব কারখানাতেই পূর্ণোদ্যমে কাজ হয়। কিছু কারখানায় কাঁচামাল স্বল্পতার কারণে শ্রমিকদের বসে দিন কাটাতে হয়। শ্রমিকদের বাসায় যাতায়াতের সুবিধার্থে বিকাল ৪টার মধ্যে অধিকাংশ কারখানা ছুটি দিয়ে দেয়।
জানতে চাইলে বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, দেশের সব জায়গার নিট কারখানা খুলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকায় কোথাও কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। সব কারখানায় পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে। তবে কয়েকটি কারখানায় কাঁচামালে সাপ্লাই চেইনে সমস্যা থাকায় শ্রমিকদের কাজ কম ছিল। এ ধরনের কারখানাগুলো নির্ধারিত সময়ের আগেই ছুটি দেওয়া হয়।
বিজিএমইএ’র সহসভাপতি আব্দুল্লাহ-হিল রাকিব বলেন, আজ (বুধবার) সারা দেশের সব গার্মেন্ট খোলা হয়েছে। গত কয়েক দিনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বেশিরভাগ কারখানায় ২-৩ ঘণ্টা ওভারটাইম করানো হয়। এতে শ্রমিকরা লাভবান হয়েছে। অনেক গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাড়িও পৌঁছে দিয়েছে।
গাজীপুর : গাজীপুরে শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপস্থিতিতে কারখানাগুলোয় কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে। গাজীপুর মিমি ডিজাইনের পোশাক শ্রমিক শাহিনা আক্তার বলেন, বৃহস্পতিবার মোবাইল ফোনে বেতন এলেও শনিবার থেকে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় টাকা তুলতে পারিনি। এজন্য বাজার করে খাওয়ার টাকাও ছিল না। বাসা ভাড়ার টাকাও দিতে পারিনি। এখন পরিস্থতি স্বাভাবিক হওয়ায় অর্থকষ্ট দূর হবে। কোনাবাড়ির তুসুকা ডেনিম লিমিটেডের শ্রমিক আবুল কালাম বলেন, বাসায় শুয়ে-বসে থাকতে অসহ্য লাগছিল। কারখানা খোলায় ভালো লাগছে।
গাজীপুরের প্রিন্ট নেটওয়ার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসান সোহেল বলেন, বুধবার সকালে কারখানা খুললেও হাতে তেমন কাজ নেই। নতুন কোনো অর্ডারও নেই। নতুন অর্ডার পাওয়ার পর স্বাভাবিক উৎপাদনে যেতে কয়েকদিন সময় লাগতে পারে। বেশ কিছুদিন আমরা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় অনেক অর্ডার বাতিল হয়েছে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করতে না পারায় ক্ষতির আশঙ্কা করেন তিনি।
চারদিন পর চালু চট্টগ্রামের দুই ইপিজেড : আবারও কর্মমুখর হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের দুই ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল)। বুধবার থেকে নগরীর ফ্রি পোর্ট এলাকায় অবস্থিত সিইপিজেড ও পতেঙ্গা স্টিল মিল এলাকায় অবস্থিত কর্ণফুলী ইপিজেড চালু করা হয়। দুই ইপিজেড চালুর খবরে এখানকার লাখো শ্রমিকের মুখে ফুটেছে হাসি। সকাল থেকেই দলে দলে তারা প্রবেশ করতে থাকেন ইপিজেডে। কাজ শেষে আবার সন্ধ্যায় ফিরেও যান তারা। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সবার চোখেমুখে ছিল স্বস্তি।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার থেকে কারখানা চালুর অনুমতি দেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এ অবস্থায় চট্টগ্রামের দুই ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেড কর্তৃপক্ষ বুধবার থেকে কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। সকাল ৭টা থেকে পানির স্রোতের মতো প্রবেশ করে শ্রমিকরা। কারখানার নিজস্ব বাসে বিভিন্ন স্থান থেকে এসে তারা প্রথমে ইপিজেডের আশপাশে নামেন। সেখান থেকে প্রধান ফটক দিয়ে তারা কর্মস্থলে প্রবেশ করেন। দুই ইপিজেডে নারী শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সোবহান বুধবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, ‘সিইপিজেডে অ্যাক্টিভ রয়েছে ১৪২টি কারখানা। এখানে শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজারের মতো। বিরূপ পরিস্থিতি ও কারফিউর কারণে চারদিন বন্ধ ছিল ইপিজেড। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ায় বুধবার থেকে তারা কারখানা খুলে দিয়েছেন। এই ইপিজেড থেকে বছরে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় বলে জানান তিনি। বুধবার কারখানা চালু করার পর সিংহভাগ শ্রমিক কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। পতেঙ্গায় অবস্থিত কর্ণফুলী ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তার অধীনে ইপিজেডে ৪০টি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করেন ৭২ হাজার শ্রমিক। বুধবার থেকে কারখানা পুরোদমে চালু হয়েছে। শ্রমিকরাও উপস্থিত হয়েছেন। জেলা পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের আলাদা নজরদারি ছিল। চারদিন পর কর্মমুখর হওয়ায় শ্রমিকদের পাশপাশি তারা নিজেরাও স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন।
সিইপিজেডে খাবার সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক জাকের আহমেদ খোকন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, চারদিন বন্ধ থাকার পর বুধবার থেকে আবারও ইপিজেডের কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তিনি এদিন সাড়ে তিন হাজার শ্রমিকের খাবার সরবরাহ করেছেন। তবে বিরূপ পরিস্থিতির কারণে এই খাবার জোগাড় করতে তাদের বেগ পেতে হয়েছে। শ্রমিকরা কাজে ফিরতে পেরে অনেকটাই আনন্দিত বলে জানান এই সাপ্লাইয়ার।
চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সুলাইমান যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রামের পুরো শিল্পাঞ্চলে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। বুধবার থেকে দুই ইপিজেড চালু হয়েছে। তিনি সিইপিজেডে অবস্থিত প্যাসিফিক জিন্স কারখানাসহ বেশ কয়েকটি কারখানা পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম শিল্পাঞ্চলকে ১১টি জোনে ভাগ করা হয়েছে। এসব জোনে বুধবার ৪৫০ ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। দুই ইপিজেডে ছিল বাড়তি সতর্কতা ও নজরদারি।
প্রাণ ফিরছে নিট গার্মেন্ট সেক্টরে : দেশের নিট গার্মেন্ট শিল্পের প্রধান কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জে প্রথমদিনেই কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন হাজার হাজার গার্মেন্টকর্মী। ফতুল্লার বিসিক, সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী ইপিজেড, কাচপুর শিল্প এলাকাসহ আশপাশ ঘুরে শ্রমিকদের কারখানায় ঢোকার চিত্র দেখা গেছে। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪শ গার্মেন্ট রয়েছে পুরো বিসিক ও আশপাশের এলাকায়। ফতুল্লার পাওলা নিটওয়্যার নামের একটি রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানার সুইং সেকশনের অপারেটর রায়হান কবির নামের এক শ্রমিক জানান, আমি কারখানায় উৎপাদনের ভিত্তিতে (প্রোডাকশনে) আয়ে কাজ করি। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিগত দিনে কোনো কাজ করতে পারিনি। কাজ না করায় কোনো আয়ও হয়নি আমার। আয় না হলেও ব্যয় কিন্তু থেমে থাকেনি। তাই যে আন্দোলন শ্রমিকের রুটি-রুজিতে আঘাত করে সেই আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারি না। ফতুল্লা অ্যাপেরেলস্ লি: নামের একটি কারখানার কিউসি সেকশনের রাইসা মণি নামের এক নারী শ্রমিক জানান, আন্দোলনের শুরুতে কয়েকদিন কারখানা খোলা ছিল। দেশের নিট গার্মেন্টস মালিকদের সর্ববৃহৎ সংগঠন বিকেএমইএ’র সহসভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সহসভাপতি মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল যুগান্তরকে জানান, ফতুল্লার বিসিকে শতভাগ প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল।