উপজেলা নির্বাচন বর্জন
ভোটের হার কম হওয়ায় সফলতা দেখছে বিএনপি
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চার ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির হার কম হওয়াকে সফলতা হিসাবে দেখছে বিএনপি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও জনগণ ভোট বর্জন করেছে বলে দাবি দলটির। নেতাদের পর্যবেক্ষণ, বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়া চলমান আন্দোলনের পক্ষে দেশের মানুষের বড় সমর্থন। তবে এ নির্বাচন কেন্দ্র করে দুই শতাধিক নেতাকে বহিষ্কারে তৃণমূলে কমেছে সাংগঠনিক শক্তি। যা কাটিয়ে উঠতে কোরবানি ঈদের পর কেন্দ্রীয় নেতাদের সারা দেশ সফরসহ নানা পদক্ষেপের কথা ভাবছে হাইকমান্ড। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্রমতে, উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে পাঠানো বহিষ্কারের তালিকার বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে তৃণমূল পর্যায়ের দ্বন্দ্ব পুঁজি করে আরও বেশ কিছু নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। সে হিসাব কেন্দ্রীয় দপ্তরে নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদে থেকে ভোট দেওয়া, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর সভা বা মিছিলে অংশ নেওয়া, পরোক্ষভাবে ভোটে সহযোগিতা করা-এসব অভিযোগে আরও অন্তত অর্ধশতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিভিন্ন জেলার ইউনিয়ন ও উপজেলা বিএনপি।
আগেই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ না নেওয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সমমনা রাজনৈতিক দলসহ নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ৬৩টি রাজনৈতিক দলও এ নির্বাচন বর্জন করে। গত ৮ মে প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলায় ভোট গ্রহণের মাধ্যমে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন শুরু হয়। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে অংশ নেওয়ায় প্রথম দফায় ৮০ জন, দ্বিতীয় দফায় ৬৯ জন, তৃতীয় দফায় ৫৫ জন ও চতুর্থ দফায় ১৩ নেতাকে বহিষ্কার করে বিএনপি। বহিষ্কৃতদের মধ্যে ২৮ জন উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন। যেসব নেতা এবারের উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি, তারা দুকূলই হারিয়েছেন। বহিষ্কৃতদের অনেকেই এখন দলে ফিরতে চান। তবে এ বিষয়ে দলটির হাইকমান্ড এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘দেশের মানুষ গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিএনপির নেতৃত্বে এখন ঐক্যবদ্ধ। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আহ্বানে দেশের ৯৩ শতাংশ মানুষ গত সাত জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে ভোটকেন্দ্রে যায়নি। একইভাবে উপজেলা নির্বাচনও দেশের মানুষ বর্জন করেছে।’
এদিকে দলের কিছু কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, জাতীয় নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তকে জনগণ সঠিক মনে করেছে। যে কারণে তারা ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যাননি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আহ্বানে জাতীয় নির্বাচনে ৯৩ শতাংশ (বিএনপির দাবি) মানুষ ভোট দিতে যায়নি। এটিকে বিএনপি বড় সফলতা হিসাবে দেখছে। কিন্তু এই সফলতার পেছনে যার কৃতিত্ব, যার আহ্বানে মানুষ ভোট বর্জন করল, দলের সেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে সেভাবে ফোকাস করা যায়নি। সফলতার কৃতিত্ব তাকে সেভাবে দেয়নি দল। সেটা না করে বরং বিএনপির একটি গ্রুপ উপজেলা নির্বাচনে যেতে মরিয়া ছিল। পরে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নানা চাপ উপেক্ষা করে এ নির্বাচনও বর্জনের সিদ্ধান্ত দেন। এমনকি ভোট বর্জনে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকেও বোঝাতে সক্ষম হন। এর পরও দলের ভেতরের ওই গ্রুপ কিছু জায়গায় প্রার্থী দিয়েছিলেন, কিন্তু ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কঠোর অবস্থান ও ভোট বর্জনের লিফলেট বিতরণের কারণে অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, ভোট থেকে সরে আসেন।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভারতের লোকসভা নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, কংগ্রেস তথা ইন্ডিয়া জোটকে সামনে তুলে আনার পেছনে, অর্থাৎ ভালো ফলের কারিগর হিসাবে রাহুল গান্ধীর ভূমিকাকে তারা ব্যাপকভাবে প্রচার করছে। সফলতার জন্য রাহুল গান্ধীকে কংগ্রেস সব কৃতিত্ব দিচ্ছে। অথচ বিএনপির পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যন যে এত বড় সফলতা দেখিয়েছেন, দল তার কৃতিত্ব সেভাবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারেনি। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে নেতাকর্মীদের মধ্যে।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দলের শীর্ষ নেতাদের মাঝেও শঙ্কা ছিল যে, দলের বড় একটি অংশ প্রার্থী হয় কিনা। প্রথম দিকে আলামতও তেমন ছিল। দলের প্রভাবশালী কিছু নেতা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে ছিলেন। কেন্দ্রীয় অনেক নেতার ইন্ধনে তৃণমূল পর্যায়ের কেউ কেউ প্রার্থীও হয়েছিলেন-এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। সূত্রে জানা যায়, এ অবস্থায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কঠোর অবস্থান এবং সারা দেশে ভোট বর্জনে লিফলেট বিতরণসহ গণসংযোগ শুরু করলে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পালটে যায়। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ার প্রবণতাও কমতে থাকে। যে-ই দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হন তাকেই বহিষ্কার করে বিএনপি।
দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলেন, বহিষ্কার করে কিছুটা হলেও তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ, যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, বিগত আন্দোলন সংগ্রামে তাদেরও কম-বেশি ভূমিকা ছিল। তাদের নামেও মামলা আছে, তারা বিভিন্ন সময়ে হামলার শিকার হয়েছেন। এসব নেতাদের কীভাবে দলে ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ভোট করে পরাজিত হন সরোয়ার হোসেন। তিনি উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন, তাকে বহিষ্কার করা হয়। সরোয়ার যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না-বিএনপির এই দাবিই সঠিক। আরও সত্য হলো, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ডাকে ভোট বর্জন করেছে মানুষ। নির্বাচনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপিই তো আমার ঠিকানা।
দলে অবশ্যই ফিরতে চাই। দলে ফেরার জন্য আবেদন করব। গাজীপুর জেলা বিএনপির সহসভাপতি ইজাদুর রহমান চৌধুরী মিলন চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করায় দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তিনি গাজীপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। মিলন জানান, ‘দলে ফেরার বিষয়ে কুরবানি ঈদের পর শপথ নিয়ে চিন্তা করব।’
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আওয়ামী প্রতারণার ফাঁদে পা না দিয়ে দেশের ভোটাররা উপজেলা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা তো নিঃসন্দেহে স্বস্তির খবর। তবে বহিষ্কৃতরা দলে ফেরার আবেদন করলে সেটি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজে দেখবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।