জিম্মিদশা কাটল ২৩ নাবিকের
মুক্ত হয়ে দুবাইয়ের পথে এমভি আবদুল্লাহ
মজুমদার নাজিম উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ’র ২৩ নাবিক ৩২ দিন পর মুক্তি পেয়েছেন। শনিবার রাত ৩টা ৮ মিনিটে জাহাজে অবস্থানরত জলদস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যায়। এরপরই মূলত অবসান ঘটে জিম্মিদশার। রোববার জাহাজটির মালিকপক্ষ চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের পক্ষ থেকে মুক্তির বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করা হয়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ৫ মিলিয়ন (৫০ লাখ) মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৫ কোটি টাকা মুক্তিপণ পাওয়ার পরই জলদস্যুরা নাবিকদের ছেড়ে দেয়। সমঝোতার মাধ্যমে জাহাজ ও নাবিকদের মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করেছেন জাহাজের মালিকপক্ষ। তবে মুক্তিপণের অঙ্ক নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি তারা।
সূত্র জানায়, মুক্তির আগে ছোট আকারের একটি উড়োজাহাজ থেকে পর পর তিনটি চক্কর দিয়ে ডলারভর্তি তিনটি ব্যাগ জাহাজটির পাশে পানিতে ফেলা হয়। মুক্তিপণ পাওয়ার ৮ ঘণ্টা পর জলদস্যুরা একাধিক দলে ভাগ হয়ে জাহাজ থেকে নেমে যায়। এরপর জাহাজটি সোমালিয়া উপকূল ত্যাগ করে দুবাইয়ের হারামিয়া বন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়া নাবিকরাই জাহাজটি নিয়ে রওয়ানা হন। এ সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যায়। আগামী ১৯ অথবা ২০ এপ্রিল জাহাজটি দুবাই পৌঁছাতে পারে। সেখান থেকেই নাবিকদের জাহাজে অথবা ফ্লাইটে করে দেশে ফেরানোর কথা রয়েছে। সুস্থ অবস্থায়ই জাহাজের সব নাবিককে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে নাবিকরা তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওই সময় তারা সুস্থ আছেন বলেও জানান। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। জাহাজটি মুক্তির বিষয়ে রোববার নগরীর আগ্রাবাদে এসআর শিপিংয়ের অফিসে সংবাদ সম্মেলন করেন মালিকপক্ষ। এসআর শিপিংয়ের সিইও মেহেরুল করিম বলেন, আমরা ইন্টারন্যাশনাল শিপিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমাদের ইন্টারন্যাশনাল আইন মেনেই ব্যবসা করতে হয়। উদ্ধার প্রক্রিয়াটাও ইন্টারন্যাশনাল ল’ অনুযায়ী একদম লিগ্যালি হয়েছে।
শনিবার ভোররাত ৩টার দিকে জিম্মি জাহাজ ও নাবিক মুক্ত হওয়ার চূড়ান্ত বার্তা পান জানিয়ে তিনি বলেন, ৯টি বোটে ৬৫ জলদস্যু চারপাশ ঘিরে ছিল। এমভি আবদুল্লাহ’র মধ্যেও জলদস্যুরা ছিল। তারা চলে যাওয়ার পর নাবিকদের সঙ্গে আমাদের ভিডিওকলে কথা হয়েছে। তারা সবাই সুস্থ আছেন।
সংবাদ সম্মেলনে কবির গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, জাহাজটি ১৯ বা ২০ এপ্রিল সংযুক্ত আরব আমিরাতে পৌঁছাবে। সেখানে কিছু ফরমালিটিজ আছে। সেগুলো শেষ করতে চার-পাঁচদিন লাগতে পারে। সেটা শেষ করে তারা হয়তো ওই জাহাজেই ব্যাক করতে পারেন অথবা ফ্লাই করতে পারেন দুবাই থেকে। সে সিদ্ধান্ত আমরা এখনো নিইনি। সময় এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। তবে জাহাজটাকে আমরা ফেরত আনছি। কারণ, জাহাজের কন্ডিশন একটু চেক করার প্রয়োজন আছে। মুক্তিপণের পরিমাণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু জিনিস আমরা প্রকাশ করতে পারব না। পাইরেসিকে আমরা এনকারেজ করতে পারব না।
জাহাজ ও নাবিকদের মুক্ত করতে সরকার সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছে জানিয়ে শাহরিয়ার জাহান বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। পরররাষ্ট্রমন্ত্রী, নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। শিক্ষামন্ত্রী টাইম টু টাইম আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। তিনি বলেন, বিদেশি যুদ্ধজাহাজ ফোর্সফুলি আমাদের জাহাজটাকেও টেকওভার করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাদের সরকারের অবস্থান ছিল, আমাদের মানুষের কোনো ক্ষতি হয় এ ধরনের কোনো অবস্থায় আমরা যাব না। আমাদের কোম্পানির পক্ষ থেকেও এ ধরনের অবস্থান ছিল।
যেভাবে দেওয়া হয় মুক্তিপণ : জানা গেছে, জলদস্যুরা নাবিকদের জাহাজের ডেকে এনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। চারপাশে অস্ত্র তাক করে ছিল তারা। একটি ছোট আকারের উড়োজাহাজ চক্কর দিয়ে জিম্মি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ’র পাশে ডলারভর্তি তিনটি হলুদ রঙের ব্যাগ পানিতে ফেলে। সব নাবিক জীবিত ও অক্ষত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরই উড়োজাহাজ থেকে ডলারভর্তি ব্যাগ ফেলা হয়। জাহাজের পাশেই সাগরে দুটি স্পিডবোটে অপেক্ষমাণ জলদস্যুরা সঙ্গে সঙ্গে পানি-প্রতিরোধী সেই ব্যাগ তুলে নেয়। এরপর ডলারগুলো পরীক্ষা করে আসল বলে নিশ্চিত হওয়ার পর দস্যুরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে স্পিডবোটে করে জাহাজ ত্যাগ করে। তার আগে বলে যায়, ‘তোমরা এখন মুক্ত’। মুক্তির আনন্দে তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন নাবিকরা। মুক্তি পাওয়ার পর জাহাজ থেকে নাবিক আইনুল তার ছোট ভাই মুন্নার সঙ্গে জাহাজ থেকে কথা বলেন। আইনুলের উদ্ধৃতি দিয়ে মুন্না সোমবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ‘মুক্তিপণের টাকা দেওয়ার সময় সব নাবিককে জাহাজের এক পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায় জলদস্যুরা। তাদেরকে তখন গানপয়েন্টে রাখা হয়। তখন তারা ভয় পেয়ে যায়। এর পর প্লেন থেকে সাগরে ডলার ফেলা হয়। সেই ডলার তুলে এনে জাহাজে গুনে দেখে ঠিক আছে কি না। এর কয়েক ঘণ্টা পর দস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে নিজেদের বোটে করে চলে যায়।’
মুক্তি পাওয়ার আগে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের সব নাবিক যে জীবিত ও অক্ষত আছেন তার ভিডিওচিত্র ধারণ করা হয়। ওই চিত্রে দেখা যায় ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ সব নাবিককে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। সেই ভিডিওচিত্র মধ্যস্থতাকারীসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছে পাঠানো হয়। এর পরই উড়োজাহাজ থেকে মুক্তিপণের ডলারভর্তি ব্যাগ সাগরে ফেলা হয় জলদস্যুদের জন্য।
কত টাকা মুক্তিপণ : মুক্তিপণের বিষয়ে জাহাজ-মালিকপক্ষ কোনো তথ্য না দিলেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, ৫ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৫ কোটি টাকা) পাওয়ার পর দস্যুরা নাবিকদের মুক্তি দিয়েছে। ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ ছাড়িয়ে আনতে জলদস্যুদের ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। দুজন জলদস্যুর বরাতে বার্তা সংস্থাটি এ তথ্য জানিয়েছে। জলদস্যুদের একজন আবদিরশিদ ইউসুফ রয়টার্সকে বলেছেন, ‘দুই রাত আগেই আমাদের কাছে ডলার আনা হয়। আমরা যাচাই করে দেখেছি, ডলারগুলো আসল না জাল। তারপর আমরা ডলারগুলো কয়েকটি দলের মধ্যে ভাগ করে সরকারি বাহিনীকে এড়িয়ে জাহাজ ত্যাগ করি।’ সব নাবিকসহ জাহাজটিকে মুক্তি দেওয়া হয় বলে জানান আবদিরশিদ ইউসুফ। সোমালিয়া সরকারের কর্মকর্তারা অবশ্য এ বিষেয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বলে উল্লেখ করে বার্তা সংস্থাটি। সোমালিয়ার একাধিক সংবাদমাধ্যমও মুক্তিপণের পরিমাণ কত সে বিষয়ে একই তথ্য দিয়েছে। সোমালিয়ার গণমাধ্যম ‘পান্টল্যান্ড মিরর’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে জানিয়েছে, ৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার মুক্তিপণ পাওয়ার পর জলদস্যুরা বাংলাদেশি পতাকাবাহী এমভি আবদুল্লাহ’কে ছেড়ে দিয়েছে।
সোমালিয়ায় ৮ জলদস্যু গ্রেফতার : সোমালিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পান্টল্যান্ডের পুলিশ আট জলদস্যুকে গ্রেফতার করেছে, যারা বাংলাদেশের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও নাবিকদের জিম্মি করার ঘটনায় জড়িত ছিল। পান্টল্যান্ড পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাতে সোমালিয়ার ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ‘গেরো’ রোববার এ খবর দিয়েছে। এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষ জানিয়েছে, জাহাজে শেষ পর্যন্ত ৬৫ জন জলদস্যু ছিল। বাংলাদেশ সময় রোববার রাত ৩টার দিকে তারা নয়টি স্পিডবোটে করে জাহাজ ছেড়ে যায়। এমভি আবদুল্লাহ মুক্ত হওয়ার কিছু সময় পর এই জলদস্যুদের গ্রেফতারের খবর এলেও তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসাবে দেওয়া অর্থ উদ্ধারের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পান্টল্যান্ড পুলিশের এক কর্মকর্তা গেরোকে বলেন, মুক্তিপণ দেওয়ার প্রবণতা জলদস্যুদের আরও বেশি জাহাজে হামলা করতে উৎসাহিত করতে পারে।
পান্টল্যান্ড মেরিটাইম পুলিশ ফোর্স রোববার বিকালে তাদের অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডেলে এক বার্তায় জানায়, তারা ভারত মহাসাগরের পান্টল্যান্ড উপকূলে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। এরকম এক অভিযানে তারা জলদস্যুদের আটক ও বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করেছে। ওই পোস্টের সঙ্গে দেওয়া চারটি ছবির একটিতে আট জলদস্যুকে দেখা যাচ্ছে, যাদের পাহারা দিচ্ছিলেন তিন পুলিশ সদস্য। গেরোর প্রতিবেদনে বলা হয়, জলদস্যুতা ঠেকাতে পান্টল্যান্ড মেরিন পুলিশ তাদের আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সঙ্গে মিলে সোমালিয়া উপকূলে নজরদারি বাড়িয়েছে।