ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতা
ঋণে সুদ বেশি আমানতে কম
মুনাফা কম পেয়ে আমানতকারীরা ও বেশি সুদ দিয়ে চাপে ঋণগ্রহীতারা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ঘোষিত সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির আওতায় সব ধরনের আমানত ও ঋণের সুদ হার বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে আমানত ও ঋণের সুদ আনুপাতিক সমান হারে বৃদ্ধির পরিবর্তে আমানতের সুদ বাড়ছে কম, ঋণের সুদ বেশি হারে বাড়ছে। গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমানতের সুদ দশমিক ৫৪ শতাংশ ও ঋণের সুদ বেড়েছে ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ওই সময়ে আমানতের চেয়ে ঋণের সুদ হার ৪ দশমিক ৫২ গুণ বেশি বেড়েছে। এতে চড়া মূল্যস্ফীতির মধ্যে আমানতকারীরা মুনাফা কম পেয়ে ও ঋণগ্রহীতারা বেশি সুদ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এদিকে সুদ হার বাড়লেও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি এখনও বাগে আসেনি। সামান্য কমে এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে।
সূত্র জানায়, গত দুই বছর ধরে দেশে চড়া মূল্যস্ফীতির হার অব্যাহত। গত অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে আসছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ঋণের সুদ হার ব্যাপকভাবে বাড়ানো শুরু হয়েছে। আমানতের সুদ হার বাড়তে শুরু করেছে গত অক্টোবর থেকে। ওই সময়ে ঋণের সুদ হার যেভাবে বেড়েছে, ওই হারে আমানতের সুদ হার বাড়েনি। গত জুলাই থেকে ঋণের সুদ হারের ঊর্ধ্বসীমা ৯ শতাংশ প্রত্যাহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদ হার নির্ধারণের জন্য করিডোর আরোপ করেছে। এতে ঋণের সুদ হার বাড়ানোর পদ্ধতি থাকলেও ব্যাংকের আমানতের ব্যাপারে কোনো পদ্ধতি নেই। ফলে ব্যাংকগুলো নিজেদের চাহিদামতো আমানতের সুদ হার বাড়াচ্ছে। এতে আমানতের সুদ হার বেড়েছে অনেক কম। এখনও মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে আমানতের গড় সুদ হার অনেক নিচে রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ওই সময়ে আমানতের গড় সুদ হার ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির হারের প্রায় অর্ধেক আমানতের সুদ হার। ফলে ব্যাংকে টাকা রাখলে এখন টাকার ক্ষয় বেশি হচ্ছে। এতেও গ্রাহকরা ব্যাংকে আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। যে কারণে আমানত বৃদ্ধির হার খুবই কম।
আলোচ্য সময়ে দুর্বল ব্যাংকগুলো তারল্য সংকট মোকাবিলায় আমানতের সুদ হার বাড়ালেও এগুলোতে গ্রাহকরা আস্থা রাখতে পারছেন না। ফলে ওইসব ব্যাংকে আমানতের প্রবাহ খুব বেশি বাড়ছে না। ভালো ব্যাংকগুলো খরচ সামলাতে আমানতের সুদ হার কম বাড়াচ্ছে। ফলে আমানতকারীরা মুনাফা কম পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে তারা ঋণের সুদ হার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত করিডোর অনুযায়ী বাড়িয়েই যাচ্ছে। এতে ঋণগ্রহীতাদের চড়া সুদ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, সঞ্চয়কারীরা সবচেয়ে বেশি আমানত রাখেন ব্যাংকে। এর মধ্যে সরকারি ও ভালো ব্যাংকগুলোতেই বেশি রাখেন। এসব ব্যাংকে আমানতের সুদ হার একেবারেই কম। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানত রাখেন খুবই কম। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানে আমানতের সুদ ব্যাংকের চেয়ে বেশি। যদিও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকের চেয়ে আমানতের সুদ কিছুটা বেশি থাকে। আগে ব্যাংকের চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানতের সুদ ১ থেকে ২ শতাংশ বেশি ছিল। এখন এ ব্যবধান বেড়ে ৩ থেকে ৪ শতাংশ হয়েছে। সরকারি খাতের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদ হার বেশ বেড়েছে। কিন্তু এসব খাতে সাধারণ সঞ্চয়কারীরা টাকা রাখেন না বললেই চলে। মানুষ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই প্রধানত টাকা রাখে। ফলে সাধারণ গ্রাহকরা যেসব খাতে বেশি সঞ্চয় করে সেগুলোর সুদ হার বাড়েনি। অথচ তাদের সঞ্চয় কম এমন সব খাতেই সুদ হার বেশি বেড়েছে।
সঞ্চয়পত্রের সুদ হার বেশি হলেও এ খাতে বিনিয়োগের বিধিনিষেধ আরোপ করে এগুলোর বিক্রি কমানো হয়েছে। ফলে এখানে সাধারণ সঞ্চয়কারীদের বিনিয়োগের সুযোগ কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত জুনে ব্যাংকে আমানতের সুদ হার ছিল ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে বেড়েছে দশমিক ৫৪ শতাংশ। গত
জুনে ব্যাংকে ঋণের গড় সুদ হার ছিল ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। ওই সময়ে সুদ হার বেড়েছে ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আমানতের চেয়ে ঋণের সুদ হার বেশি বেড়েছে ৪ দশমিক ৫২ গুণ।
একই সঙ্গে সরকারি খাতের বিল ও বন্ডের সুদ হারও বেড়েছে। আলোচ্য সময়ে তিন মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদ ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ হয়েছে। ওই সময়ে এ খাতে সুদ বেড়েছে ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ৬ মাস মেয়াদি বিলের সুদের হার ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ দশমিক ৪২ শতাংশ। ওই সময়ে এর সুদ বেড়েছে ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদ হার ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ হয়েছে। এর সুদ বেড়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
গত জুনে দুই বছর মেয়াদি বন্ডের সুদ ছিল ৮ দশমিক ০৯ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ হয়েছে। আলোচ্য সময়ে সুদ বেড়েছে ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ।
একই সময়ে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানতের সুদ হার ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আমানতের সুদ হার বেড়েছে দশমিক ৭২ শতাংশ। একই সময়ে ঋণের সুদ ৮ দশমিক ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ হয়েছে। আলোচ্য সময়ে ঋণের সুদ বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এ খাতে আমানতের চেয়ে ঋণের সুদ হার বেড়েছে ৪ দশমিক ৯৬ গুণ বেশি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আমানতের সুদ হারের সীমা ও মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে সমন্বয় করে আমানতের সুদ দেওয়ার বিধান প্রত্যাহারের ফলে বাজারে আমানতের সুদ হারে প্রতিযোগিতা ফিরে এসেছে। সুদ হার বাড়লেও ব্যাংকে তারল্য কিছুটা কমে আবার চাপ বেড়েছে।
সূত্র জানায়, আমানতের সুদ হার প্রতিযোগিতামূলক হলেও ঋণের সুদ হার করিডোরের জালে বন্ধি। ফলে এখানে প্রতিযোগিতা আসেনি।
ব্যাংকগুলোতে সব ধরনের ঋণের সুদ হার বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে। এরপরই রয়েছে বড় শিল্প খাত। এই দুই খাতেই সুদ হার বেশি বেড়েছে। এসএমই খাতে গত জুনে গড় সুদ ছিল ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এ খাতে সুদ বেড়েছে ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ। একই সময়ে বড় শিল্পে সুদ হার ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ হয়েছে। ওই সময়ে এ খাতে সুদ বেড়েছে ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
একই সময়ে কৃষি খাতে সুদ হার ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ হয়েছে। এ খাতে সুদ বেড়েছে ২ দশমিক ০৩ শতাংশ।
আলোচ্য সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি নির্ধারণী সুদ হারও বেড়েছে। গত জুনে রেপো বা পলিসি রেট ছিল ৬ শতাংশ। এখন থেকে হয়েছে ৮ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে এ খাতে সুদ বেড়েছে ২ শতাংশ।
এদিকে যে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদ হার বাড়াচ্ছে। তাতে এখনও নিয়ন্ত্রণ আসেনি। ২০২২ সালের জুনে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ।