কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্যে তোলপাড়
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিএনপি নেতাদের জেলমুক্তি ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে তোলপাড়। তিনি এমন এক সময়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে এ কথা বলেন, যখন নির্বাচনি ট্রেনে চড়ার আর কোনো সুযোগ নেই বিএনপির। দলটি বলছে, কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে কোর্ট-কাছারি সবই সরকারের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তিনি (আবদুর রাজ্জাক) যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি তার একান্ত ব্যক্তিগত। আওয়ামী লীগ দলীয় নিয়মনীতি ভঙ্গ করে এমন উদ্ভট প্রস্তাব বিএনপিকে দেয়নি। অপরদিকে টিভি চ্যানেলকে দেওয়া বক্তব্যে কোনো কিছু ভুল বলেননি বলে সোমবার মন্তব্য করেছেন কৃষিমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ওই বক্তব্য আমার ব্যক্তিগত হলেও আমার দল চায়, সবাই অংশগ্রহণ (নির্বাচনে) করুক।
সরকার বিএনপিকে এমন উদ্ভট প্রস্তাব দেয়নি: ওবায়দুল কাদের
নির্বাচনে আনার জন্য বিএনপি নেতাদের কারাগার থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল-কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের এমন বক্তব্য তার নিজস্ব বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সোমবার আওয়ামী লীগের সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, তিনি (কৃষিমন্ত্রী) যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা তার ব্যক্তিগত। আওয়ামী লীগ কোনো দেউলিয়া দল নয় যে দলীয় নিয়মনীতি ভঙ্গ করে এ ধরনের উদ্ভট প্রস্তাব বিএনপিকে দেবে। এ ধরনের কোনো প্রস্তাব আমাদের সরকারও দেয়নি, আমাদের দলও দেয়নি।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বিএনপির ২০ হাজার নেতাকর্মী জেলে আছে; আমরা তা স্বীকার করি না। জেলে কতজন আছে; হিসাবটা আমি মির্জা ফখরুল ইসলামের কাছে অনেকবার চেয়েছি। একটা উদ্ভট সংখ্যা বলে দিল, সেটা সবাই বিশ্বাস করবে এমন নয়। এত লোক গ্রেফতার হয়নি। আর যারা পুলিশ পিটিয়ে হত্যা করেছে, প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা করেছে, হাসপাতালে হামলা করেছে; তাদেরকে তো আইনের আওতায় আসতেই হবে। কাউকে নির্বাচনে আনার জন্য অপরাধকে ক্ষমা করতে হবে-এমন দল আওয়ামী লীগ নয়।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষ ওই নেতার বক্তব্যের বিষয়ে দল কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দলই সিদ্ধান্ত নেবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না; আর কীভাবে ব্যবস্থা নেবে, সেটাও দলের বিষয়।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে আসেনি। তাই এখানে জোট করার প্রয়োজনীয়তা নেই। জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট হয়নি, সমন্বয় হয়েছে। এটা আমাদের নির্বাচনি কৌশল। তবে বিএনপি সংসদ নির্বাচনে থাকলে নির্বাচনি কৌশল ভিন্ন হতো।’
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘দলীয় প্রার্থীসহ সব প্রার্থীর মধ্যে (নির্বাচন কমিশন) প্রতীক বরাদ্দের পর আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে। আমি আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও দলীয় নেতাকর্মীদের নির্বাচনি আচরণবিধি মেনে চলতে আহ্বান জানাই। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ২০ ডিসেম্বর (বুধবার) হযরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহ পরান (রহ.)-এর মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে সিলেটে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথম জনসভা করবেন। ২৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করবেন তিনি।’
তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২৭টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আমরা জাতীয় পার্টির জন্য ২৬ আসন থেকে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছি। শরিক দলের প্রার্থীরা ছয়টি আসনে নৌকা নিয়ে নির্বাচন করবেন। সবমিলিয়ে ২৬৩ জন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। ১৪ দলসহ নৌকার প্রতীকে থাকছেন ২৭০ জন। স্বতন্ত্র আছেন ৩৫৭ জন। আর এখন পর্যন্ত ১৮৮৬ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি নেতা নজরুল সাহেব বলেছেন, সোমবারের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে কারা এমপি হচ্ছেন। এ ধরনের ভাগবাঁটোয়ারা করে নির্বাচন বিএনপির আমলেই সম্ভব। তারা তো বঙ্গবন্ধুর খুনি রশিদ, নূর, হুদা ছাড়া প্রার্থীই পাননি। উনি এখন জ্যোতিষী, গণকের ভূমিকা নিচ্ছেন। এতই যদি ভবিষ্যৎ পড়তে পারেন, তাহলে জানান কবে তারেক রহমান দেশে ফিরে বিচারের মুখোমুখি হবে।’
সংসদ ভেঙে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছেন ৪০ বুদ্ধিজীবী। এ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আসলে তারা (বুদ্ধিজীবী) বিএনপির রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। তাদের বিবৃতি দেওয়ার আগে উচিত ছিল বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো। যখন তাদের বিবৃতি দেওয়া উচিত ছিল, তখন তারা দেয়নি। তাদের উচিত ছিল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না বলে তিরস্কার করা। যে বুদ্ধিজীবীরা জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ সাপোর্ট করছেন, তারা আসলে বিএনপির দালাল।’
জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা হলে প্রতিপক্ষ কারা-প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ থেকে তারা সাপোর্ট চেয়েছে। আরও বড় সংখ্যায় আসন চেয়েছিল। আমরা ২৬টি আসনে সমঝোতা করতে পেরেছি। সেজন্য আমরা নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করেছি। বাকি আসনগুলোয় তারা লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে। আসন সমঝোতা নতুন কিছু নয়। ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনেও এমন সমঝোতা হয়েছিল। তবে এবার আমরা খুব কমই সহযোগিতা করতে পেরেছি।’
সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, মির্জা আজম ও সুজিত রায় নন্দী, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য সাখাওয়াত হোসেন শফিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আমি যা বলেছি ভুল বলিনি: কৃষিমন্ত্রী
বিএনপিকে নির্বাচনে আনা নিয়ে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, ‘ওই বক্তব্য আমার ব্যক্তিগত, দলের নয়। আমি মনে করি আমার দল চায় সবাই অংশগ্রহণ (নির্বাচনে) করুক।’ সোমবার সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
প্রসঙ্গত, রোববার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘নির্বাচনে আনার জন্য বিএনপির নেতাদের কারাগার থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। তবে বিএনপি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।’
একদিন পরেই তার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা তুলে ধরতে গিয়ে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনেক কথার মধ্যে এসেছে। আমি যা বলেছি, আমি ভুল বলিনি। আমার বক্তব্য একদম ঠিক আছে। কিন্তু অনেক কথার মধ্যে এসেছে তো... কাজেই গণমাধ্যমে এটুকু বক্তব্য এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। তাদের আমরা নির্বাচনে আনতে চাই। কিন্তু আমাদের সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমার বক্তব্যের মূল কথা ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় চেয়েছেন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করুক। সেটি বলতে গিয়ে আমি নির্বাচন কমিশনের কথা বলেছি। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে আসেনি।’
তিনি বলেন, ‘আমি বলতে চেয়েছি যে, আওয়ামী লীগ আন্তরিকভাবে বিএনপির অংশগ্রহণ চেয়েছে। এই কথাটি বলতে গিয়ে আমি সেদিন কিছু কথাবার্তা বলেছি। আমি সেদিন এটিও বলেছি যে, বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে চায়। তারেক রহমানের নামে মামলা রয়েছে, তার সাজা হয়েছে। সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তার মা অসুস্থ, তারও সাজা হয়েছে। কাজেই আমার ধারণা, বিএনপি নির্বাচনে আসতে চায় না, তারা নির্বাচন বানচাল করতে চায়।’
কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বক্তব্য হলো, সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনোভাবেই নির্বাচন করা সম্ভব না। পৃথিবীর কোনো দেশেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নেই। জাপান, ভারত, শ্রীলংকা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা... পৃথিবীর কোথাও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলতে কিছু নেই। কাজেই আওয়ামী লীগের সামনে কোনো বিকল্প নেই। এই কথাটিই বলেছি। এই পদ্ধতির মধ্যে থেকে বিএনপি বলতে পারত নির্বাচনকে কীভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ করা যায়। সে ক্ষেত্রে আমরা আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন নিতে পারতাম। বিদেশ থেকে আরও বেশি পর্যবেক্ষক আসতেন। ওসিদের বদলি করা হচ্ছে। এভাবে এসপিদের বদলি করা যেত, ডিসিদের করা যেত। অর্থাৎ সংবিধান অনুসারে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেখে, এই সরকারকে রেখে নির্বাচনটাকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে যা যা করা দরকার, আওয়ামী লীগ সেটি করতে চেয়েছে। কিন্তু বিএনপি সেটি বিশ্বাস না করে আন্দোলনে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালিয়েছে, ট্রেন লাইন কেটে নাশকতা করেছে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে রাজশাহীতে কীভাবে তারা পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, প্রায় চারশ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলেছি যে, আওয়ামী লীগের জন্য কী গন্তব্য ছিল? আপনারা জানেন, তারা ট্রেন লাইনে কীভাবে নাশকতা করেছে। এই নাশকতা বন্ধ করতে হলে গ্রেফতার তো করতেই হবে। বিএনপি নেতাদের হুকুম ছাড়া কী কোনো কর্মী বাসে আগুন দেবে? সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতদিন সরকারে আছে, তার দায়িত্ব হলো মানুষের জীবনের ও জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া।’
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এমন প্রেক্ষাপটে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা যদি নির্বাচনে আসত তাহলে স্বীকার করে নিত যে, তারা আর সন্ত্রাস করবে না। তার মানে শান্তি আসত। নির্বাচন কমিশনারই বারবার বলেছে, প্রয়োজনে নির্বাচন পিছিয়ে দেবে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বড় বড় নেতাদের কারাগারে রেখে কী নির্বাচন হবে? সেটি একটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জামিন দিয়ে... তাদের আমি ছেড়ে দেব বিষয়টি তো এমন নয়। জামিন দিয়ে আইনের মাধ্যমে তাদের ছেড়ে দিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হতো। নির্বাচন কমিশনই এমনটা ভেবে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য বলেন, ‘নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো বিএনপি যদি রাজি হয়, তাহলে নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। সেই কথাটাই আমি বলেছি, এটা আবারও বলছি।’
কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য প্রমাণ করে সবকিছু পূর্বপরিকল্পিত: রিজভী
‘একতরফা’ নির্বাচনে বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক সম্পর্কে কৃষিমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যকে ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে’ বলে মন্তব্য করেছেন রুহুল কবির রিজভী। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী বলেন, কৃষিমন্ত্রীর স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে মহাসমাবেশে পুলিশি তাণ্ডব-হত্যাকাণ্ড, চলমান যত সহিংসতা, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার-সবকিছু পূর্বপরিকল্পিত। শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী হাটে হাঁড়ি ভেঙে স্বীকার করলেন, দেশের আইন-আদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, কোর্ট-কাচারি, বিচার-আচার-সবকিছুই আওয়ামী মাফিয়া সরকারের হাতে বন্দি। সোমবার দুপুরে ভার্চুয়ালি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের সম্পূর্ণ মিথ্যা সাজানো মামলায় জেলে পুরে এবং সারা দেশে বাড়িঘরছাড়া করে তাড়িয়ে বেড়ানোর গোমর ফাঁস করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। রোববার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘নির্বাচনকে নির্বিঘ্ন-কণ্টকমুক্ত করার জন্যই বিএনপির ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে রাখা হয়েছে। চিন্তাভাবনা করেই এ কাজ করেছি। তাদের জেলে না ভরলে দেশ অচল হয়ে যেত। হরতালের দিন গাড়ি চলত না। তিনি আরও বলেন, বিএনপিকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তারা নির্বাচনে এলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে। শুধু পিছিয়ে দেওয়া নয়, বলা হয়েছিল সবাইকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। এমনকি এক রাতে সব নেতাকে জেল থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি রাজি হয়নি।’
বিএনপি নেতা রিজভী বলেন, বিচার বিভাগ আইনের গতিতে নয়, চলছে গণভবনের গতিতে। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগকে কার্যত আওয়ামী লীগের একটি ইউনিটে পরিণত করা হয়েছে। পরীক্ষিত আওয়ামী লীগের নেতাদের বেছে বেছে সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ১৫ বছর ধরে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে। স্বাধীন বিচার বিভাগ ও আইনের শাসনের আওয়ামী নমুনা কৃষিমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট হয়েছে। নির্বিঘ্নে নির্বাচন করতে পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ২০ হাজার নির্দোষ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সারা দেশের নির্দোষ নেতাকর্মীদের কারাগারে গাদাগাদি করে রাখা হচ্ছে। জামিনের অধিকারও খর্ব করা হয়েছে। শেখ হাসিনা (প্রধানমন্ত্রী) চাইলে গ্রেফতারদের এক রাতেই ছেড়ে দিতে পারেন। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করলে এক রাতেই মুক্তি দেওয়া কোনো গণতান্ত্রিক দেশে, কোনো আইনের শাসনের দেশে, এমনকি ডিক্টেটর-শাসিত অনেক দেশেও সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, এতে এটা প্রমাণ হয়-বর্তমান আওয়ামী মাফিয়া সরকার পৃথিবীতে সর্বোচ্চ জুলুমের এক অদ্ভুত স্বৈরতান্ত্রিক এবং একনায়কতন্ত্রিক সরকার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এ সরকারকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। শেখ হাসিনা আজীবন ক্ষমতায় থাকার লিপ্সায় চারবারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিনা অপরাধে ফরমায়েশি রায়ে কারারুদ্ধ করে রেখে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করেছে-একথাই শতভাগ সত্য। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে একটির পর একটি মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হচ্ছে। সবকিছুর হিসাব রাখছেন দেশের জনগণ। এই নজিরবিহীন অবিচারের বিচার একদিন হবেই হবে।
রিজভী বলেন, বিচারব্যবস্থা আর আওয়ামী লীগ একাকার হয়ে গেছে। পৃথক কোনো সত্তা নেই। দেশে কোনো আইন নেই। সব শেখ হাসিনার (প্রধানমন্ত্রী) ইশারাই চলছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেড় লাখ মামলা দায়ের আর অর্ধকোটি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। কারাগারে নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে সরকারের ব্লুপ্রিন্টে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্যে বাংলাদেশের জনগণ হতভম্ভ উল্লেখ করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, প্রথিতযশা সাংবাদিক ও লেখক এমজে আকবর বাংলাদেশে এসে রোববার এক সেমিনার শেষে সংবাদ সম্মেলনে নিশিরাতের ভোট ডাকাত, ১৫ বছর বন্দুকের নলের মুখে জনগণের ঘাড়ে দৈত্যের মতো চেপে বসা গণবিচ্ছিন্ন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে স্তূতি আর প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছেন। তার বক্তৃতা শুনে তার সম্পর্কে যারা অবগত, তারা রীতিমতো বিস্মিত-হতবাক হয়েছেন।
রিজভী বলেন, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্য বাংলাদেশের জনগণকে অবজ্ঞা করার শামিল। ভারত কি তাহলে বাংলাদেশের জনগণকে উপেক্ষা করে শুধু আওয়ামী লীগকেই বন্ধুত্বের বন্ধনে আঁকড়ে রাখতে চায়? এমজে আকবরের মন্তব্য কর্তৃত্বসুলভ এবং বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছাকে অসম্মান করা। বাংলাদেশ কোনো স্যাটেলাইট স্টেট নয়। বাংলাদেশের জনগণ কোনো দেশের প্রোটেক্টরেট নয়। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতাবঞ্চিত। চলমান আন্দোলন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং জনগণের মালিকানা জনগণকে ফেরত দেওয়া। আমরা তো ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাই না। বাংলাদেশি নাগরিকরা অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সমমর্যাদার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়াতে বিশ্বাস করে। জনগণ বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগের ভোট চুরির দোসর হবে না ভারত। প্রতিবেশী হিসাবে এদেশের ১৮ কোটি জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পক্ষে ভারত দাঁড়াবে-এটাই এদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে।