জনবল নিয়োগের প্রশ্নপত্র ফাঁস
একাধিক কর্মকর্তা জড়িত বিপুল অর্থের লেনদেন
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর
আমিরুল ইসলাম
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ফাঁসের সঙ্গে অধিদপ্তরের একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনার আগে ও পরের সিসি ক্যামেরা (ক্লোজ সার্কিট) ফুটেজ থেকে তাদের প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের অভিযোগ-পরীক্ষার আগে জেলায় জেলায় প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছে নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব উপপরিচালক আবুল কাশেমের কম্পিউটার অপারেটর মো. শাহজাদা। আবুল কাশেম পশ্নপত্র ফাঁসের মূল পরিকল্পনাকারী।
এছাড়া জেলা পর্যায়ের একাধিক উপরিচালক, সংস্থার প্রধান কার্যালয়ের দুজন সহকারী পরিচালক এবং একজন অফিস সহায়কের নাম উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন হয়েছে। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মুহাম্মদ ওয়াহেদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলমান।
অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা ও চাকরি প্রত্যাশীদের অভিযোগ-মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাশ করিয়ে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে ওই পরীক্ষা বাতিল করা হয়।
২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৫০৪টি পদে জনবল নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সংস্থাটি। ২৭ জন ডে-কেয়ার ইনচার্জ, ৬০ জন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক এবং ৪১৭ জন অফিস সহায়ক নিয়োগ দেওয়ার কথা।
১৩ অক্টোবর রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ২০টি কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীরা প্রবেশ করার পর হঠাৎ জানানো হয় পরীক্ষা নেওয়া হবে না। কোনো কারণ উল্লেখ না করে এবং পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই এমন ঘোষণায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের প্রধান ফটকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীন যুগান্তরকে বলেন, পরীক্ষাটি সম্ভবত পিএসসি এবং মন্ত্রণালয় নিতে পারে। আমি সবটুকু জানি না। আমার গলা ব্যথা এখন কথা বলতে পারছি না।
তিনি সংস্থাটির পরিচালক মনোয়ারা ইশরাতের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এরপর মনোয়ারা ইশরাত যুগান্তরকে বলেন, যা ঘটেছে তা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। যেহেতু বিষয়টি তদন্তাধীন সেহেতু এ বিষয়ে এখন কোনো কথা বলতে চাই না।
১৩ অক্টোবর প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব আবুল কাশেম এবং তার কম্পিউটার অপারেটর মো. শাহজাদা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান। শাহজাদার মূল পদ হচ্ছে হিসাবরক্ষক কাম ক্রেডিট সুপারভাইজার। তবে সে আবুল কাশেমের একান্ত অনুগত এবং কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে কাজ করেন।
শাহজাদা নিজেই প্রশ্নপত্র তৈরির সময় ছিলেন এবং বগুড়া জেলার উপপরিচাক মো. শহিদুল ইসলামকে হোয়াটঅ্যাপে পাঠান।
এ বিষয়ে জানাতে চাইলে বগুড়ার উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম শনিবার মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘পরীক্ষার দিন সকাল ৬টার দিকে আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ আসে। প্রথমে মনে করেছি আমার মেয়ের প্রশ্ন। পরে পড়ে দেখি অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে জনবল নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। পাঠিয়েছে প্রধান কার্যালয় থেকে শাহজাদা। কারণ তার নম্বর আমার মোবাইল ফোনে আগে থেকেই সেভ করা ছিল। আমি প্রথমে স্ক্রিনশট নিতে গিয়ে ভুলে তা ফেসবুকে শেয়ার হয়ে যায়। ফেসবুকে শেয়ার হওয়ার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। কারণ আমি মোবাইলের ব্যবহার ভালোভাবে জানি না। পরে আমাকে সংস্থার প্রধান কার্যালয় থেকে ফোন করে ঢাকায় এনে লিখিত ও মৌখিক সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
উপপরিচালক শহিদুল ইসলাম আরও জানান, অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে তো অস্বীকার করতাম। মিথ্যার আশ্রয় নিতাম। আমি ঘটনা স্বীকার করে কর্তৃপক্ষের কাছে জবানবন্দি দেওয়ার পর কাশেম সাহেবের কম্পিউটার অপারেটর আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। সে বলেছে তার কিছু হলে সে আমাকে ছাড়বে না। সংস্থার পরিচালকের উপস্থিতিতেই সে আমাকে হুমকি দিয়েছে। তখন আমি বলেছি, ম্যাডাম নিরাপত্তার জন্য আমি জিডি করতে চাই।
সংস্থাটির একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা জানান, নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব আবুল কাশেম জেলায় জেলায় ডিডিদের মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করে তাদের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন সরবরাহ করেন। তার সহযোগী হিসাবে ছিলেন কম্পিউটার অপারেটর শাহজাদা। বিপত্তি ঘটে বগুড়ার ডিডি ভুলে প্রশ্নপত্র ফেসবুকে শেয়ার করায়। ঘটনার পরপরই সংস্থাটির পরিচালক মনোয়ারা ইশরাতের জিজ্ঞাসাবাদে শাহজাদা বলেন, তার স্ত্রী মোবাইল ফোন থেকে সব তথ্য মুছে ফেলেছেন।
কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই শাহজাদা এবং আবুল কাশেমের বক্তব্য রেকর্ড করেছে। তাদের বক্তব্য রেকর্ড করার সময় আবুল কাশেম ও শাহজাদা নিজেদের নির্দোষ দাবি করলে সংস্থাটির পরিচালক মনোয়ারা ইশরাত বলেছেন, কাশেম সাহেব আপনি ক্যাঙ্গারু হলে শাহজাদা ক্যাঙ্গারুর বাচ্চা। শাহজাদা আপনার কম্পিউটার অপারেটর। সে আপনার সঙ্গে ডিউটি করে। আপনারা কিভাবে নির্দোষ দাবি করছেন।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে উপপরিচালক মো. আবুল কাশেম ও তার কম্পিউটার অপারেটর মো. শাহজাদা ছাড়াও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত আছেন।
নিয়োগ কমিটিতে সচিবের প্রতিনিধি হিসাবে থাকা যুগ্মসচিব নাহিদ মঞ্জুরা আফরোজ যুগান্তরকে বলেন, আমি এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না। আমার কোনো সম্পৃক্ততাও নেই।
উপপরিচালক মো. আবুল কাশেমের মন্তব্য নিতে সোম ও বৃহস্পতিবার মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে গিয়ে জানা গেছে, তিনি অফিসের বাহিরে আছেন। এরপর ওই ২ দিন তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পাশাপাশি এই প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে একই নাম্বারে এসএমএস পাঠিয়ে তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত এসএমএসের উত্তর আসেনি।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (এডি) মো. আব্দুল অদুদ যুগান্তরকে বলেন, আমি নিয়োগ কমিটিতে নেই। সুতরাং কিছুই জানি না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার পর ১৩ ও ১৪ তারিখ উপরিচালক মো. আবুল কাশেমের রুম তালা দিয়ে রাখে কর্তৃপক্ষ। পরে সেই রুম খুলে দেওয়া হয়। সোম ও বৃহস্পতিবার অধিদপ্তরে গিয়ে উপপরিচালক আবুল কাশেমের কম্পিউটার অপারেটর মো. শাহজাদাকেও পাওয়া যায়নি। তবে একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী এই প্রতিবেদককে জানান, ‘আপনার সাংবাদিক পরিচয় জেনে সে গা-ঢাকা দিয়েছে। অফিসেই আছেন।’