আইএমএফ চায় খেলাপি কমানোর নির্দিষ্ট পরিকল্পনা
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার নামিয়ে আনতে একটি ‘সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা’ চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পাশাপাশি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি। তবে সন্তোষ প্রকাশ করেছে ‘সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন’ পাশ হওয়ায়। রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে এসব জানতে চাওয়া হয়। একই দিন মিশনের প্রতিনিধিদল পৃথকভাবে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও বৈঠক করে। সেখানে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় নতুন ফর্মুলা কবে নাগাদ কার্যকর করা হবে, তা জানতে চায়। বিপরীতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয় এ ফর্মুলা আগামী বছরের প্রথমদিকে বাস্তবায়নের চিন্তা করছে সরকার।
এছাড়া আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে ডলারের বিনিময় মূল্য ‘এক রেট’ এবং বৈশ্বিক সংকটের মুখে রপ্তানি আয় বাড়াতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। সচিবালয়ে আইএমএফ প্রথম বৈঠক করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে। আর্থিক বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলিম উল্লাহর নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন বৈঠকে। সেখানে ব্যাংকিং খাতের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরা হয়। এ বিষয় জানতে চাইলে কোনো মতামত দিতে রাজি হননি আর্থিক বিভাগের সচিব।
তবে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, আইএমএফ প্রতিনিধিদল মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিষয়ে তাগিদ দিয়েছে। এজন্য একটি পরিকল্পনাও আমাদের কাছে চেয়েছে। আমরা বলেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমওইউ করা আছে। সেখানে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।
সূত্র জানায়, আইএমএফ-এর সঙ্গে বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি তুলে ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। দেখা যায়, চলতি বছরের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৯৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৪ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকাই ছিল খেলাপি, যা বিতরণকৃত ঋণের ২৫ শতাংশ। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষেও রাষ্ট্রায়ত্ত এ ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। ওই সময় ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল খেলাপির খাতায়। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে এসব ব্যাংকের ১৭ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা নতুন করে খেলাপি হয়েছে। আর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর মূলধন কাঠামো আরও ভঙ্গুর অবস্থায় পড়েছে। বেড়েছে ব্যাংকগুলোর সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতির পরিমাণও। ফলে জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ছয় ব্যাংকের নিট খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বরাবরই খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর (এমওইউ) করার পরামর্শ দিয়েছে এ দাতা সংস্থাটি। এর ব্যাখ্যা হিসাবে বৈঠকে উপস্থিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয় ‘বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ)’ হচ্ছে। প্রতিবছরই খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য ব্যাংকগুলোয় পৃথকভাবে টার্গেট দেওয়া হচ্ছে।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক : এদিকে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের বৈঠকে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের নতুন ফর্মুলা কার্যকরের বিষয়ে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটির শর্ত অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ে নতুন কার্যকর ফর্মুলা চালু করার কথা। তবে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নতুন ফর্মুলা প্রণয়নের কাজ শেষ। এখন এটি আগামী অর্থবছর থেকে কার্যকর হবে। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে দপ্তরে গিয়ে যোগাযোগ করা হলে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব মো. নুরুল আলম কথা বলতে রাজি হননি।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করতে নতুন ফর্মুলা প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে মাসিক মূল্য সমন্বয়ের পাশাপাশি সাপ্তাহিক ভিত্তিতে করার চিন্তাও করছে সরকার। কারণ, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি সপ্তাহে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় হয়। সে ফর্মুলা কার্যকর করতে বিপিসিকে একটি চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়। সেখানে বিদ্যমান ব্যবস্থায় জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ ৫ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ কল্যাণ চার্জ নেওয়া হচ্ছে, সেটি প্রত্যাহার করতে বলা হয়। এছাড়া পর্যালোচনা করে আরও দেখা যায়, প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রিতে ৯ টাকা লোকসান এবং অকটেনে মুনাফা হচ্ছে ১৬ টাকা। এখানে আয় ও লোকসান সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববাজারে যেভাবে দাম বাড়ছে, এই ফর্মুলা অনুযায়ী সমন্বয় হলে দেশের বাজারে আরও বাড়বে। কিন্তু এরই মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চলে আসছে। ফলে এ মুহূর্তে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়াতে চাচ্ছে না। যে কারণে নতুন ফর্মুলা কার্যকর করা থেকে মন্ত্রণালয় সরে আসছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের বিপরীতে আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, তার একটি হচ্ছে জ্বালানি তেলের ওপর থেকে ভর্তুকি কমিয়ে আনা। জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া। এতে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দেওয়ার প্রবণতা কমে আসবে। এর আগে গত মে মাসে আইএমএফ প্রতিনিধিদল জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে মূল্য সমন্বয় করার তাগিদও দিয়ে গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক : এদিকে আইএমএফ মিশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও বৈঠক করেছে। আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে ডলারের বিনিময় মূল্য ‘এক রেট’ এবং বৈশ্বিক সংকটের মুখে রপ্তানি আয় বাড়াতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, নানাভাবে রপ্তানিকারকদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন নীতিগত সহায়তা দিয়ে ব্যবসার খরচ কমানো হচ্ছে। এভাবে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।