ইসির কর্মপরিকল্পনা প্রকাশের এক বছর আজ

আস্থা অর্জনের চেয়ে বেড়েছে সংকট

‘বাস্তবতা ও প্রত্যাশা’ নিয়ে আজ কর্মশালায় বসছে কমিশন * দুই দফায় আমন্ত্রণ জানিয়েও বিএনপি ও মিত্রদের সঙ্গে সংলাপে বসতে পারেনি ইসি
 কাজী জেবেল 
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচন কমিশন ১৪টি চ্যালেঞ্জ ঠিক করে এক বছর আগে কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করে। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি এর অন্যতম। একই সঙ্গে পরিকল্পনায় চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণে ১৯টি উপায় উল্লেখ করা হয়। তবে সিসি ক্যামেরা দিয়ে ভোটগ্রহণ পর্যবেক্ষণসহ ওই কর্মপরিকল্পনার অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে সরে এসেছে কমিশন।

পর্যবেক্ষকদের মতে, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরপিও সংশোধনসহ এ পর্যন্ত যে কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে, তার অনেক ক্ষেত্রে ইসির ওপর আস্থা সৃষ্টির পরিবর্তে বেড়েছে সংকট। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। অনেক কিছু বাদ দিলেও কমিশন নির্বাচনি মালামাল ক্রয়সহ ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে সেই কর্মপরিকল্পনা ধরেই।

বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলোকে দুই দফায় চিঠি দিয়েও এখন পর্যন্ত আলোচনার টেবিলে আনতে পারেনি কমিশন। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে আগামী নির্বাচনে এসব দলের অংশগ্রহণ নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দলগুলো এই কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিবর্তে তাদের পদত্যাগ দাবি করছে। এ অবস্থায় আজ সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকদের কয়েকজনের সঙ্গে আবারও আলোচনায় বসতে যাচ্ছে ইসি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, কর্মশালার নামে আয়োজিত আজকের এ সংলাপের আলোচ্য বিষয় ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’। ‘ভিন্নধর্মী’ এ সংলাপে ২৮ জন অতিথি অংশ নেবেন বলে তাদের সম্মতি ইসিকে জানিয়েছেন। ইসির পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের মধ্যে চারজন আলোচক, চারজন পর্যালোচক ও বাকি ২০ জন অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন। আলোচকদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান আছেন। এটি সফল হলে আরও কয়েকটি সংলাপের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। আর যদি ইসির নেতিবাচক আলোচনাই বেশি উঠে আসে তাহলে এটিই হবে শেষ সংলাপ। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের কোনো পরিকল্পনা নেই ইসির। বিদ্যমান রাজনৈতিক দূরত্ব নিরসনেও কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেবে না।

এই কর্মশালা অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক হবে কিনা-তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, গত বছরের জুলাই পর্যন্ত ইসি ধারাবাহিক সংলাপ করেছিল। ওইসব সংলাপে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে বেশিরভাগ মতামত এসেছিল। ইসি ওই মতামত উপেক্ষা করে জাতীয় নির্বাচনে ১৫০ আসনে এ মেশিনে ভোট নেওয়ার প্রকল্প নেয়। যদিও সরকার আর্থিক সংকটের কারণে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি পাশ করেনি। তিনি বলেন, এই কমিশন অনেক কাজ করেছে যা তাদের ওপর আস্থা বাড়ানোর চেয়ে সংকট তৈরি করেছে। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। সেখানে প্রার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়মের ঘটনায় রাঘববোয়লদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। চুনোপুঁটিদের (নির্বাচন কর্মকর্তা) ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপ নিলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া আরপিও সংশোধনসহ কয়েকটি পদক্ষেপে তাদের ওপর মানুষের আস্থাহীনতার পাল্লা ভারী হয়েছে। জাতীয় সংকট বাড়ছে। আমরা আরেকটি একতরফা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি।

কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয় না বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। তিনি যুগান্তরকে বলেন, অতীতে কোনো নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল আসেনি। আগামী নির্বাচনেও হয়তো কিছু দল আসবে না, আবার হয়তো আসবে। তবে আমরা চাই সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে আগামী নির্বাচনে কারা আসবে তা আগাম বলা যাবে না।

ইসি সূত্র জানায়, গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনা’ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এতে ১৪টি চ্যালেঞ্জ ও চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে ১৯টি উপায় উল্লেখ করা হয়। এর প্রায় সবই নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা থেকে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত সময়ের জন্য। অল্প কয়েকটি তফশিল ঘোষণার আগে বাস্তবায়ন করার কথা উল্লেখ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিনিময়ে উঠে আসা সুপারিশ বাস্তবায়ন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যেক ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, আরপিও সংশোধন অন্যতম। এছাড়া ইসির নিয়মিত কাজ হিসাবে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ও পর্যবেক্ষক নিবন্ধন কার্যক্রম রয়েছে।

ইসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আরপিওর ৯০এ ধারা সংশোধনী আনার মাধ্যমে নির্বাচন বন্ধে ইসির ক্ষমতা খর্ব হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়ে কমিশন। সমালোচনার কারণে ওই সংশোধনীতে থাকা সাংবাদিকদের কাজে বাধা দিলে শাস্তির বিধান, ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব স্পষ্ট করাসহ অন্য সংশোধনীগুলো চাপা পড়েছে। যদিও সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল দাবি করেন, ওই সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সুসংহত হয়েছে।

তারা আরও জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন একটি বড় রাজনৈতিক বিষয়। এবার অখ্যাত দুটি দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টিকে (বিএসপি) নিবন্ধন দেওয়া হয়। এ দুটি দলকে নিবন্ধন দেওয়ায় ইসির অভিপ্রায় নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এছাড়া ভোটকেন্দ্র নির্ধারণে এবারই প্রথম ডিসি-এসপি এবং ইউএনও-ওসিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের নীতিমালা জারি করে কমিশন। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের ক্ষমতা কমিয়ে তৈরি করা ওই নীতিমালা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ প্রক্রিয়ার ফলে সারা দেশে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগামী নির্বাচনে এসব ভোটকেন্দ্র নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভোটকেন্দ্রের মতো একই প্রক্রিয়া ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল তৈরির নীতিমালা প্রণয়ন নিয়েও ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে। আরপিওর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধান রেখে তৈরি করা ওই নীতিমালা যদিও কমিশন সভায় পাশ হয়নি।

এছাড়া গত বছরের ১৩ মার্চ থেকে ৩১ জুন পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে দেশের শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। অবশ্য বিএনপিসহ ৯টি রাজনৈতিক দল সংলাপ বর্জন করে। ওই সংলাপে উঠে আসা প্রস্তাবগুলোর সারসংক্ষেপ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়। এরপর আর তেমন কোনো তৎপরতা নেই। অন্যদিকে বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সংলাপে আসা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের বিষয়েও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। যদিও নির্বাচনকালীন সরকার, ইসির অধীনে কয়েকটি মন্ত্রণালয় রাখাসহ অনেক বিষয় তাদের এখতিয়ারভুক্ত নয় বলে দাবি করে আসছে কমিশন।

চলছে নির্বাচনি মালামাল কেনা : সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, আইন সংশোধন, নতুন দল নিবন্ধন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ভোটগ্রহণের জন্য নির্বাচনি মালামাল যেমন ৯০ হাজার গানি ব্যাগ, এক লাখ ৬৫ হাজার হেসিয়ান ব্যাগ, ১৪ লাখ ৩৫ হাজার মার্কিং সিল, ৭ লাখ ১৫ হাজার অফিসিয়াল সিল, এক লাখ ব্রাশ সিল, ৮০ হাজার স্বচ্ছ ব্যালট বক্সসহ বিভিন্ন মালামাল কিনতে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে ইসি। আগামী ১০ নভেম্বরের মধ্যে এসব মালামাল ইসির গোডাউনে প্রবেশ করার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু কিছু মাল ইসিতে এসে পৌঁছেছে। এছাড়া বিজি প্রেসে নির্বাচনের বিভিন্ন ধরনের খাম ও ফরম ছাপার কাজ চলছে। তফশিল ঘোষণার পর ব্যালট পেপার ছাপা হবে। এসব কাজের জন্য ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৪ রিম কাগজ সংগ্রহ করেছে বিজি প্রেস। আগামী ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির শুরুতে ভোটগ্রহণের লক্ষ্য রেখে এসব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন