বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকা নয়ছয়ের আশঙ্কা
অপ্রয়োজনে ৯০ শতাংশ ব্যয়
১ হাজার ২৮ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব

হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বব্যাংকের ঋণের প্রকল্পে লুটপাটের আয়োজন করা হয়েছে। ১ হাজার ২৮ কোটি টাকার মধ্যে পরামর্শক নিয়োগ ও প্রয়োজন নেই এমন জনবল খাতেই ধরা হয়েছে ৯২৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
এটি মোট প্রকল্প খরচের প্রায় ৯০ শতাংশ। সেই সঙ্গে যেনতেন সম্ভাব্যতা সমীক্ষার মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে প্রকল্প প্রস্তাব। এক্ষেত্রে একেকজন পরামর্শকের বেতন ৫ লাখ টাকা ধরা হলেও তাদের অভিজ্ঞতা ছাড়াই শুধু এমএ পাশ যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে। অন্যান্য জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও আছে শিথিলতা।
এ অবস্থায় ঋণের টাকা নয়ছয়ের আশঙ্কা করছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এসব ত্রুটি ধরা পড়লে প্রকল্পটি ফেরত দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে এটি নতুন করে পুনর্গঠন করার সুপারিশ দেওয়া হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘আরলি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট ক্যাপাসিটি এনহ্যান্সমেন্ট অব পারটিসিপেটিং ইউনিয়ন পরিষদ’ শীর্ষক প্রকল্পে ঘটেছে এমন ঘটনা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন প্রস্তাব যারা তৈরি করেন তাদের জবাবদিহিতা না থাকা এবং উল্লেখযোগ্য শাস্তির নজির নেই বলেই এ ধরনের প্রস্তাব আসা বন্ধ হচ্ছে না।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, এটা ভয়ংকর প্রস্তাব। আমরা চাই প্রকল্প হোক, মানুষের উপকারে লাগুক। কিন্তু এমন অপ্রয়োজনীয় ব্যয় প্রস্তাব কারও কাম্য নয়। এটা আমার পর্যন্ত এখন আসার কথা ছিল না। এরপরও যখন বিষয়টি জানলাম তখন খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিকল্পনা কমিশন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে। কিন্তু যারা প্রস্তাব এনেছে তাদের তিরস্কার বা জবাবদিহিতার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দেখার দায়িত্ব। আমরা আমাদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে থেকে যতটুকু করা যায় তাই করছি।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ডা. মো. সারোয়ার বারীর সঙ্গে।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ প্রকল্পটি যখন প্রথম প্রস্তাব করা হয় তখন পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ মেনে এর একটি বড় অংশ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মায়েদের নগদ টাকা দেওয়ার অংশটি। বাকি দুই অংশ যেমন ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে কো-অর্ডিনেট করা, মায়েদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করিয়ে দেওয়া এবং ইউনিয়ন পরিষদকে অনুদান দেওয়ার অংশ স্থানীয় সরকার বিভাগ করবে।
জনবল নিয়োগ অংশের পুরোটিই আমাদের অংশে আছে। এজন্য মনে হয় সব শুধুই জনবল নিয়োগ করা কাজ। এটা ঠিক নয়। তবে পরিকল্পনা কমিশন সুপারিশ দিলে যতটুকু সম্ভব কমানো হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী জনবলের বেতন ধরা হয়েছে। এছাড়া লুটপাটের আয়োজন কিনা? এর জবাবে তিনি তেমন কোনো মন্তব্য করেননি।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ‘আরলি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট ক্যাপাসিটি এনহ্যান্সমেন্ট অব পারটিসিপেটিং ইউনিয়ন পরিষদ’ প্রকল্প প্রস্তাবটি নিয়ে দুদিন পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ৩১ জুলাই প্রথম এবং ৭ আগস্ট দ্বিতীয় সভাটি হয়। ২২ আগস্ট জারি করা হয় পিইসি সভার কার্যবিবরণী। এতে দেখা যায়, প্রকল্পের মোট ব্যয় ১ হাজার ২৮ কোটি টাকা।
এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৩৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে ৯৯১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয় করার কথা। প্রক্রিয়াকরণ শেষে এটি অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে শুরু হয়ে ২০২৮ সালের আগস্টের মধ্যে বাস্তবায়নে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিডি)।
পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য হলো মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবার পরিচর্যা ও উন্নয়নমূলক কাজ। ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) পরীক্ষা করে দেখা যায় প্রকল্পটির কার্যক্রম স্থানীয় সরকার বিভাগ সংশ্লিষ্ট নয়। সভায় স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিনিধি জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর্মরত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের সহযোগিতা নেওয়া হবে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের ওপরই আমি হতাশ। কেননা সবাই প্রত্যাশা করে বিশ্বব্যাংকের ঋণ মানে প্রকল্পের মান নিশ্চিত হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত প্রকল্পটিতে যেমন প্রস্তাব করা হয়েছে এতে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এখানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন আছে। শিশুদের জন্য এমন প্রকল্প দরকার। কিন্তু ৫ লাখ টাকা বেতন দিয়ে শুধু এমএ পাশ লোক এখানে শিশুদের উন্নয়নে কী করবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন শিক্ষাবিদ, পুষ্টিবিদ, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোক। কিন্তু প্রস্তাবিত জনবল দিয়ে কীভাবে লক্ষ্য পূরণ হবে সেটি প্রশ্নবিদ্ধ।
কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দ্বিতীয় পিইসি সভায় অংশ নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পল্লী প্রতিষ্ঠান উইং) সভাকে বিস্তারিত জানান। তিনি বলেন, প্রকল্পে পারফরম্যান্স বেইজডগ্রান্ট (পিবিজিএস) পরামর্শক, সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট, সিনিয়র ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট, সিনিয়র গ্রান্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট এবং সিনিয়র অডিট স্পেশালিস্টসহ মোট চারটি পর্যায়ে জনবল নিয়োগ করা হবে।
এগুলোর ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৪৬০ কোটি ৬১ লাখ, ৩৮ কোটি ৬১ লাখ, ৪২৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকাসহ মোট ৯২৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। যেটি মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৯০ শতাংশ। বাকি ১০ শতাংশ অর্থাৎ ১০২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা রাখা হয়েছে অফিস ভাড়া, কম্পিউটার, অফিস আসবাবপত্র, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য খাতের ব্যয়।
তিনি আরও জানান, সামাজিক সুরক্ষা সুপারভাইজার ও সামাজিক সুরক্ষা সহকারী সংক্রান্ত চারটি পদের জন্য মোট ৭ হাজার ৫০১ জন নিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে। এজন্য ব্যয় হবে ৪২৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। তবে এই জনবল কীভাবে এবং কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হবে তার কোনো রূপরেখা স্পষ্ট করা হয়নি।
অথচ বর্তমানে পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মা ও শিশু সহায়তা কার্যক্রম চলছে। এর আওতায় স্থায়ী জনবল কাঠামোতে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মচারীরা এসব কাজ করছেন। এ পর্যায়ে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের প্রতিনিধি বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দ্বৈতধার সৃষ্টি করবে।
ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, যেহেতু প্রকল্পটির বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি উঠেছে পিইসি সভায় সেহেতু নিশ্চয়ই এর যৌক্তিকতা আছে। আশা করা যায় পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ মেনে এখন নতুন করে ঢেলে সাজানো হবে। সেটি এমনভাবে করা হবে যাতে অনিয়ম বা অপচয় সংঘটিত না হয়।
কেননা এই প্রকল্পের সিংহভাগ টাকাই বিশ্বব্যাংকের ঋণ। আপাতত মনে হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে টাকাটা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তারা তো বেনিয়া। সুদসহ এই টাকা ফেরত দিতে হবে। এর দায়ভার বহন করবে জনগণ। এজন্য মনে রাখতে হবে প্রকল্পটিতে যাতে কোনোরকম অনিয়মের সুযোগ না থাকে। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক কীভাবে অর্থায়নে সম্মত হলো সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলা উচিত। কেননা বিশ্বব্যাংকও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়।
সভায় আরও বলা হয়, সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, সিনিয়র ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, সিনিয়র গ্রান্ট ম্যানেজমেন্ট এবং সিনিয়র অডিট স্পেশালিস্টের মাসিক বেতন ধরা হয়েছে ৫ লাখ টাকা করে। অথচ তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়নি। শুধু এমএ পাশ শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া কিছু পদে বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধু স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। যেমন, ডিজাস্টার ফ্যাসিলেটর পদের জন্য মাসিক বেতন ধরা হয়েছে ১ লাখ টাকা। এগুলোর যোগ্যতা গ্রহণযোগ্য নয়। এ সময় সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রতিনিধি বলেন, পরামর্শকের সংখ্যা যৌক্তিকভাবে কমানো প্রয়োজন। সভায় পরামর্শক ও জনবল সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), অর্থ বিভাগ এবং আইএমইডির কর্মকর্তারা।
আলোচনা শেষে পিইসি সভায় মতামত দিয়ে বলা হয়, ১০২৮ কোটি টাকা প্রকল্পে ঋণ হচ্ছে ৯৬ শতাংশ। এছাড়া প্রকল্পের পিবিজিএস পরামর্শক ও প্রয়োজন নেই এমন জনবল নিয়োগেই বরাদ্দ ধরা হয়েছে মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৯০ শতাংশ। এক্ষেত্রে প্রকল্পটির উল্লেখিত উদ্দেশ্য কীভাবে অর্জিত হবে তা প্রকল্পের কার্যক্রমে স্পষ্ট নয়। তাই সম্পদের সুষ্ঠু ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবহার এবং বৈদেশিক ঋণের এ প্রকল্পে দৃশ্যমান আউটপুট পেতে পুনর্গঠন করার পক্ষে একমত প্রকাশ করা হয়।