রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর
প্রত্যাবাসনে আলো নেই, সাহায্যও কমছে
মাসুদ করিম, ঢাকা ও জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার
প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর অতিবাহিত হলেও সংকট সমাধানে কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। যদিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত কিছু অগ্রগতি হয়েছে।
মিয়ানমার বলছে, একটি পাইলট প্রকল্পের অধীনে ডিসেম্বরের মধ্যে সাত হাজার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেবে। তবে পশ্চিমা বিশ্ব এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী মিয়ানমারে নিরাপদ পরিবেশ নেই বলে এ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিরোধিতা করছে।
তবে এখন পর্যন্ত একজনকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। বরং রোহিঙ্গাদের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। জয়েন্ট রেসপন্স টিম চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক সাহায্যের জন্য আবেদন করেছিল। এর বিপরীতে আগস্ট পর্যন্ত সাহায্য মিলেছে মাত্র ২৮ শতাংশ। বৈদেশিক সহায়তা কী পরিমাণ কমেছে, এ থেকে সহজেই অনুমেয়।
এদিকে দিন যতই যাচ্ছে, ক্যাম্পে বাড়ছে রোহিঙ্গা শিশু জন্মের হার। ছয় বছরে ক্যাম্পে প্রায় দেড় লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে বলে দাবি করেন ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট সংশ্লিষ্টরা।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের খাবারের খরচও কমিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) আগে একজন রোহিঙ্গার জন্য খাবার খরচ বাবদ মাসে ১২ ডলার দিয়েছে। মার্চে তা কমিয়ে করা হয়েছে ১০ ডলার। জুনে আরও কমিয়ে আট ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দাতাই সাহায্য কমিয়ে দিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অবশ্য দেশগুলোকে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের কাজ দেওয়ার জন্য দাবি করছে।
কিন্তু বাংলাদেশ সরকার মনে করে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে কাজ দিলে প্রত্যাবাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহ দেখাবে না। তবে বাংলাদেশ সরকার অবশ্য রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের ভেতরে কাজ করার অনুমতি দিচ্ছে। এছাড়া উখিয়া-টেকনাফ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ঘনত্ব কমাতে নোয়াখালীর ভাসানচরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গার আবাস গড়া হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
এদিকে রোহিঙ্গারা তুচ্ছ ঘটনায় খুনোখুনি ছাড়াও মাদকের ব্যবসা, অপহরণ ও ধর্ষণের মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। ছয় বছরে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহসহ ১৩১টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে।
তবে বিভিন্ন সংস্থা ও বেসরকারি তথ্যমতে ছয় বছরে ক্যাম্পে দুই শতাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিতে গিয়ে প্রায় আট হাজার একরের বেশি বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। বিপর্যয় ঘটেছে পরিবেশের। এ কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে পাহাড়ধসের ঘটনাও। এতে প্রাণহানিও ঘটছে প্রতিবছর।
ব্রিকস সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান করছেন। জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন জোহানেসবার্গ থেকে টেলিফোনে বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকটের সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। সমাধানও মিয়ানমারকে করতে হবে। মিয়ানমারকে বাদ দিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধান সম্ভব নয়। আমরা চাই, রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাক। তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোই আমাদের অগ্রাধিকার। তবে আমি আশাবাদী, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য কবে নাগাদ ‘সেফটি ও সিকিউরিটি’ নিশ্চিত করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে, সেটা বলতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে আমরা কাজ করছি। এখনো সফল হইনি। বিভিন্ন লোক প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে।’ যদিও কারা প্রত্যাবাসনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে, সেটা তিনি বলেননি। এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি, বিদেশি সাহায্য যাতে না কমে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমন সংকট দেখা দিয়েছে। যারা সাহায্য করে, তাদের ইউক্রেনের দিকে আকর্ষণ বেশি।’
তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা মনে করেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ ও তৎপরতায় এখন পর্যন্ত কোনো ফল পাওয়া না গেলেও প্রক্রিয়াগত অগ্রগতি আছে। সরকারের ‘রিলিফ, রিপাট্রিয়েশন অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন কমিশনার’ (ট্রিপলআরসি) মিজানুর রহমান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠাতে না পারলেও প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া সম্পাদনে অগ্রগতি আছে। মিয়ানমার থেকে প্রতিনিধিদল এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। রোহিঙ্গারাও রাখাইন রাজ্যে গিয়ে দেখে এসেছে সেখানকার অবস্থা। অনেককে তাদের আগের বাড়িঘরেই নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে মিয়ানমার। তারা ওইসব এলাকার নামও বলেছে। ফলে মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে সর্বাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মিয়ানমার বেশকিছু রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই করেছে। মিয়ানমার ৫৬ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই করে দিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে তাদের আরও সন্তান হয়েছে। ফলে তালিকা আবারও যাচাই করা প্রয়োজন। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করে। সেই তালিকা থেকে এক-দশমাংশ কেবল মিয়ানমার যাচাই সম্পন্ন করেছে।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এই প্রক্রিয়াগত দিকের শেষ কোথায় জানতে চাইলে ট্রিপলআরসি বলেন, ‘মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল আবারও বাংলাদেশে আসার প্রস্তাব দিয়েছে। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেবে বলে টার্গেট দিয়েছে।’ রোহিঙ্গাদের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ব্যাপক হারে কমে গেছে।
কীভাবে এ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রাখা যায়, সে বিষয়ে চেষ্টা চলছে। বুধবারও ক্যাম্পে বিশেষ সভা করেছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান, গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ও সংশ্লিষ্টরা এসব বৈঠকে যোগ দেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত ৩ হাজার ২০টি মামলা হয়েছে। (এসবে অস্ত্র মামলা ২৩৮টি, মাদক মামলা ২ হাজার ৫৭টি, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার মামলা ৯৪টি এবং অপহরণ মামলা হয়েছে ৪৪টি। এছাড়াও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৭টি, ডাকাতি ও ডাকাতি প্রস্তুতি মামলা ৬২টি, হত্যা মামলা ১১টি, মানব পাচারে ৩৭টি মামলা হয়েছে।) যেখানে আসামি করা হয়েছে ৬ হাজার ৮৩৭ জন রোহিঙ্গাকে। খুনোখুনি, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানব পাচার, অগ্নিসংযোগসহ ১৪ ধরনের অপরাধে এসব মামলা হয়েছে।
মিয়ানমারের একটি সীমান্ত চৌকিতে হামলার অজুহাতে রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন শুরু করলে ২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বর্তমানে কক্সবাজারে অবস্থিত দুটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত ভাসানচরে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। মিয়ানমারের বর্তমান সামরিক জান্তা আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে থাকায় পাইলট প্রকল্পের অধীনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য কিছুটা আগ্রহ দেখাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সহায়তার মাধ্যমে পদক্ষেপের চিন্তা করা হলেও পশ্চিমারা মনে করে, মিয়ানমারে সামরিক জান্তার পতন হলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান সহজ হবে। যদিও অং সান সু চি’র নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আগ্রহ দেখায়নি। তাছাড়া চীন ও রাশিয়ার ভেটোর আশঙ্কায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশন রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত নিষ্ঠুরতাকে জাতিগত নিধন বলে অভিহিত করেছে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিজে) রাষ্ট্র হিসাবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে (আইসিসি) দমন-পীড়নে অংশ নেওয়া মিয়ানমারের সেনা ও বেসামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা মামলার কাজও চলছে।