বিএনপির তালিকায় পুলিশে অস্বস্তি
মাহমুদুল হাসান নয়ন
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিএনপি লোগো
ঘোষণা দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের নামের তালিকা করছে বিএনপি। দলটির ভাষ্য, এ তালিকায় গুম, খুন, হামলা, নিপীড়ন, কর্মসূচিতে বাধা, মামলা, গায়েবি মামলা দেওয়ায় সরাসরি জড়িত ঊর্ধ্বতন পুলিশ সদস্যরা আছেন। সারা দেশে স্থানীয় নেতাকর্মী ও নির্যাতিত পরিবারের দেওয়া তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী অতি উৎসাহী কর্মকর্তাদের শনাক্ত করা হচ্ছে। তালিকায় কোন কোন কর্মকর্তার নাম আছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি বিএনপি। জানানো হয়নি মোট কর্মকর্তার সংখ্যাও। দলটির বিভিন্ন সূত্র থেকে এ তালিকার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে এরই মধ্যে অনলাইনে বেশকিছু তালিকা ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলো অনেকে মোবাইলে চালাচালি করছেন। ফলে এই তালিকা নিয়ে অনেক পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে অস্বস্তি বিরাজ করছে। তালিকার উদ্দেশ্য নিয়ে পুলিশসহ সব মহলেই কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
এখন পর্যন্ত বিএনপির নামে পুলিশ সদস্যদের অন্তত পাঁচটি তালিকার খবর সামনে এসেছে। তালিকার আকাড় হিসাবে ৬৬৪, ৫০০, ৬৩২, ৩৪৯ ও ৪০৮৭-এই পাঁচটি সংখ্যা পাওয়া গেছে। হাজারের মধ্যে থাকা তালিকাগুলোয় পদ হিসাবে পুলিশের ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপি, অ্যাডিশনাল এসপি, এএসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নাম আছে। আর হাজার অতিক্রম করা বড় তালিকায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়াও আছে বিভিন্ন থানার ওসি ও বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে আলোচিত মামলাগুলোর বাদী এসআই-এএসআইদের নামও। বিএনপি বলছে, তারা জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের মাধ্যমে এ তথ্য সংগ্রহ করছে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি, ভিডিও ও সংবাদের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। তালিকাগুলো বিদেশি দূতাবাস ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোয় পাঠানো হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি জনগণের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে এসব তালিকা করছে। বিদেশিদের কাছে বিচার দিচ্ছে। এগুলো করে কোনো লাভ হবে না। জনগণ আর তাদের পক্ষ নেবে না। এগুলো করে তারা পুলিশকে ভয় দেখায়। পুলিশ যেন চুপচাপ বসে থাকে। পুলিশ চুপচাপ বসে থাকলে তো চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ সব অপরাধ বাড়বে। এ তালিকায় ভীত হওয়ার মতো কোনো অবস্থাই নেই। তারা (বিএনপি) তালিকা দেওয়ার কে? বিদেশিরা এসব তালিকা দিয়ে কী করবে? তারা আদালত নাকি? তারা (বিদেশিরা) কি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারে?’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশে এখন চার ধরনের কর্মকর্তা আছেন। এক. একসময়ে ছাত্ররাজনীতিতে পদ-পদবি ছিল অথবা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী আওয়ামী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। দুই. পরিবার বা নিজের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই; কিন্তু বিভিন্ন কারণে রাজনৈতিকভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তিন. সম্পূর্ণ পেশাদার পুলিশ কর্মকর্তা। চার. আওয়ামী আদর্শের নন; কিন্তু বর্তমানে নীরব ভূমিকায় থেকে চাকরিতে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি কিংবা বিএনপির তালিকা নিয়ে এই চার শ্রেণির প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান ভিন্ন। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে প্রত্যেক শ্রেণির কর্মকর্তাদের গতিবিধি সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে দমন-পীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। এই শ্রেণির বড় একটি অংশ ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) কর্মরত। এছাড়া পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) অনেকে কর্মরত। কাজ করছেন অন্যান্য ইউনিটেও। কেবল ডিএমপিতেই এসি (এসএসপি) থেকে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিআইজি) পর্যন্ত এমন অন্তত ৩১ জন কর্মকর্তা আছেন, যাদের অন্তত ২১ জন ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদে ছিলেন। তাদের মধ্যে ১১ জনের সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। তাদের প্রত্যেকেই জানিয়েছেন, তারা তালিকার পরোয়া করছেন না। যে কোনো পরিস্থিতিতেই দায়িত্ব পালন করে যাবেন। তবে এমন কয়েক জনের প্রত্যাশিত পদায়ন না পাওয়া নিয়ে অভিমানও আছে।
তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং একসময়ে ছাত্রলীগের দাপুটে নেতা ছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপিতে কর্মরত এই পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘যখন ছাত্ররাজনীতি করেছি, দাপটের সঙ্গে করেছি। আমাদের পরিচয় লুকানোর কিছু নেই। এখন চাকরি করছি পেশাদারির সঙ্গে। কে কী তালিকা করল, তাতে কিছু আসে-যায় না। এ নিয়ে অস্বস্তিরও কিছু নেই। সময়ই বলে দেবে কী হবে। আইনের মধ্যে থেকে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিবার বা নিজের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই; কিন্তু বিভিন্ন কারণে রাজনৈতিকভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন-তারা সবচেয়ে বেশি রহস্যজনক ভূমিকায় আছেন। তারা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চাকরির সুবাদে, আঞ্চলিকতার কারণে কিংবা সরকার সমর্থিতদের সঙ্গে আত্মীয়তার সুযোগে বাহিনীতে দীর্ঘ সময় প্রভাব নিয়ে চলেছেন। তাদের মধ্যে বিভিন্ন জেলায় এসপি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন বা করছেন এমনও আছেন। অথচ ভিসানীতি ও বিএনপির তালিকার পর এই শ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই এখন নিজেকে ‘পেশাদার পুলিশ’ কর্মকর্তা প্রমাণে ব্যস্ত। তারা এই তালিকা নিয়ে একধরনের অস্বস্তিতে আছেন।
এছাড়া বাহিনীতে পেশাদার পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত এমন সংখ্যাও কম নয়। যারা পেশাগত দায়িত্ব পালনের বাইরে কিছু ভাবছেন না। এমন সাতজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। তারা বলছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তারা সেটি করছেন। কখনোই অতি উৎসাহী ভূমিকায় ছিলেন না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে যেভাবেই ক্ষমতায় আসুক, তারা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন। কাজের প্রতি একনিষ্ঠতার কারণেই কেউ তাদের ফেলে দিয়ে কিছু চিন্তা করতে পারবেন না। তবে অনলাইনে ভেসে বেড়ানো তালিকাগুলোয় পেশাদার অনেক কর্মকর্তার নামও রয়েছে, যা স্বস্তিদায়ক নয়।’ অতীতে রাজনৈতিক পরিচয় ছিল-এমন অনেকের মধ্যেও এ ধরনের চিন্তা দেখা গেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ও বিএনপির তালিকা নিয়ে সবচেয়ে উৎসাহী ভূমিকায় আছেন আওয়ামী আদর্শে বিশ্বাসী নন; কিন্তু বর্তমানে নীরব ভূমিকায় থেকে চাকরি করছেন-এমন কর্মকর্তারা। এ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে পরিচিত অনেক কর্মকর্তার মধ্যে ক্ষোভও আছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ‘কে কী তালিকা করল, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। আমরা রাষ্ট্রের কর্মচারী। আমরা সরকারের দায়িত্ব পালন করি। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা দেখাশোনা করি। এগুলো আমাদের দায়িত্ব। এই তালিকা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। তারা (বিএনপি) রাজনীতি করবে, রাজনৈতিক স্বার্থে কত কী করতে পারে। এটা তাদের রাজনৈতিক গেম। আমরা আইনের বাইরে কোনো কাজ করি না। এজন্য এসব তালিকা নিয়ে আমাদের কোনো টেনশনও নেই।’
এদিকে পুলিশ সদস্যদের নিয়ে বিএনপির তালিকার বিষয়ে বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই বলছেন, বিএনপি ঢালাওভাবে তালিকা করলে তারা যে সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তখন দেশ চালাবে কীভাবে? কারণ, তালিকাগুলোয় পুলিশবাহিনীতে অত্যন্ত পেশাদার কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত অনেকের নামও রয়েছে। অনেকে আবার বলছেন, এমন তালিকার ফলে পুলিশে ঐক্য বাড়তে পারে। তালিকায় নাম আসা কর্মকর্তারা একজোট হয়ে যেতে পারেন, যা বিএনপির জন্য সুখকর কিছু হবে না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, গণমাধ্যমে পুলিশ কর্মকর্তাদের নানা তালিকা প্রকাশ হচ্ছে। এমন কোনো তালিকা আমরা করছি না। পুলিশ প্রশাসনে আতঙ্ক তৈরির জন্য কোনো একটি মহল বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এ নিয়ে পেশাদার কর্মকর্তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যারা পেশাগত দায়িত্ব পালন না করে সরকারের নির্দেশে দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করেছে বা করছেন, তাদেরই আমরা চিহ্নিত করছি। প্রয়োজন মনে করলে সেগুলো আমরা বিদেশি মিশনগুলোয় পাঠাই। এর সঙ্গে ভিডিও, ছবি, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সংযুক্ত করা হয়।